Trending

অস্বাভাবিক মৃত্যু কীসে কত

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুজনের আত্মহননের ঘটনা আলোড়ন তৈরি করে। তাদের অস্বাভাবিক এই মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়। দুজনের মধ্যে একজন সাদি মহম্মদ, যিনি দেশসেরা সংগীতশিল্পী ছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে সাদি মহম্মদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। একদিকে মা ও বোনের মৃত্যু তাকে একাকী করে দেয়, অন্যদিকে কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়েও অভিমান ছিল। ফলে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে মনে করছেন স্বজন ও সহশিল্পীরা। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন। যে পোস্টে অবন্তিকা তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিক ও জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যান।

কেবল সাদি মহম্মদ কিংবা অবন্তিকাই নন, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যু বা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর তালিকায় সবচেয়ে ওপরে রয়েছে আত্মহত্যার নাম। শুধু তা-ই নয়, করোনা মহামারীর সময় সংক্রমণে প্রথম বছরে দেশে যেখানে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়, তখন একই সময়ে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।

আত্মহত্যায় মৃত্যু নিয়ে দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে ধারাবাহিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গবেষণা হয়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন ও বছরে ১০ হাজার ২০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। এর ৭ বছর পর আঁচল ফাউন্ডেশন আত্মহত্যা নিয়ে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ এক বছরে আত্মহত্যা করে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এই সময়ে দিনে গড়ে আত্মহত্যা করে প্রায় ৪০ জন করে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয় প্রায় ১৩ হাজার মানুষের।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে মানসিক রোগ বেশি। যদিও মানসিক রোগে ভুগতে থাকা ৯২-৯৪ শতাংশই রয়েছে চিকিৎসার বাইরে। মানসিক রোগের চিকিৎসা নিলে সমাজ বিষয়টি নেতিবাচকভাবে নেবে এমন ভয়ে পরিবারের সদস্যরা চান না সমস্যায় থাকা ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে।

তারা বলেন, বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, প্রতিযোগিতা ও সামাজিক বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ভার্চুয়াল নাগরিকে পরিণত করছে। ফলে তারা মনের অজান্তে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নিঃসঙ্গতা আত্মহত্যার একটা বড় কারণ। সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় যারা পিছিয়ে যায়, তারা জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। সময়মতো চাকরি না পাওয়া, আবার পেলেও সমাজ ও পরিবারের চাহিদা পূরণ না হওয়াও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। যারা ক্যারিয়ারের শীর্ষে ওঠে তাদের প্রতিযোগিতা থামে না; বরং আরও বেড়ে যায়। প্রেমঘটিত কারণেও আত্মহত্যা বাড়ছে।

২০২৩ সালে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এই সময়ে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২৭ জন স্কুলশিক্ষার্থী, কলেজশিক্ষার্থী ১৪০ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে ২০৪, নারী ৩০৯ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। প্রতি বছর আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৮ লাখ, যার ৭৫ শতাংশই ঘটে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোয়। আত্মহত্যার তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম এবং ভারতের অবস্থান প্রথম।

জরা-ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট, প্রকৃতির বৈরী আচরণের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই মানুষ বেছে নেয় স্বেচ্ছায় মৃত্যু, যাকে বলা হয় আত্মহত্যা। মানুষের মৃত্যু হতে পারে স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক এই দুই উপায়ে। অস্বাভাবিক মৃত্যু বলতে যে মৃত্যুর জন্য মানুষের প্রস্তুতি নেই, যা সতর্ক হলে এড়ানো সম্ভব। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যায় মৃত্যু, পানিতে ডুবে মৃত্যু, হত্যাকাণ্ড, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু ইত্যাদি।

অস্বাভাবিক মৃত্যুর তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে এ ধরনের মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের জন্য নাগরিক সমাজ নানা আন্দোলন ও জনমত গড়ে তোলে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৯০২; ২০২২ সালে ৯ হাজার ৯৫১; ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮০৯; ২০২০ সালে ৬ হাজার ৬৮৬; ২০১৯ সালে ৭ হাজার ৮৫৫; অর্থাৎ এই ৫ বছরে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৪১ জনের। সে হিসাবে এই ৫ বছরে দিনে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের।

সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডে আগুন লেগে মারা যায় ৪৫ জন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে দেশে অগ্নিকান্ডে মারা গেছে ১০২ জন। এ ছাড়া ৭ বছরে দেশে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭০৯টি অগ্নিকাণ্ডে ২ হাজার ৮৮৪ জন মারা গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের চেয়েও বছরে বেশি মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) গবেষণা অনুযায়ী, গড়ে বছরে অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হয় পানিতে ডুবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষকে সাপে কামড়ায় এবং তাদের মধ্যে ৭ হাজার ৫১১ জন মারা যায়। সাপের কামড়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ভুক্তভোগী গ্রামীণ অঞ্চলের এবং নারীদের তুলনায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি পুরুষ সাপের কামড়ের ঝুঁকিতে থাকে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যায়। সংস্থাটির এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে ২ হাজার ১৪২ জন মারা গেছে। আর ট্রেনে কাটা পড়ে বছরে মারা যায় ৫০০ জনের মতো।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করছে আঁচল ফাউন্ডেশন। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত আত্মহত্যার ৩২২টি ঘটনা পর্যালোচনা করে সংস্থাটি। তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৪৯ শতাংশ। ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ। ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী আত্মহত্যাকারী ১১ শতাংশ এবং ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৫ শতাংশ। অন্যান্য দেশে নারীর তুলনায় আত্মহত্যায় পুরুষরা এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশে তার বিপরীত। দেশে আত্মহত্যাকারীদের ৫৭ শতাংশ নারী, পুরুষ ৪৩ শতাংশ।

আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা খুঁজে পায় পারিবারিক, সম্পর্কজনিত, আর্থিক টানাপড়েন, পড়াশোনা এবং বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। এই সময়ে সর্বাধিক ৩৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে বিভিন্ন পারিবারিক কারণে, এরপরই ২৪ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে সম্পর্ক ও আর্থিক ও লেখাপড়াজনিত কারণে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব আত্মহত্যার পেছনেই আত্মহত্যাকালীন ব্যক্তির মানসিক অবস্থার অবনতি ছিল। বিষন্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া, মুড ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগে ভুগছিল। আর এ কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। এ ছাড়া এই রোগগুলোর প্রতি একধরনের বদনাম জড়িয়ে আছে, ফলে সংকোচের কারণে অনেকেই এগুলোর চিকিৎসা করাতে সচেষ্ট হয় না, উৎসাহিত হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে মানুষ আরও বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে যারা মানসিক রোগে ভুগছে এর মধ্যে ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে রয়েছে। দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) ৩৫০, মনোবিজ্ঞানী (সাইকোলজিস্ট) ৫ শতাধিক, এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মানসিক স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসার বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor