আমদানি-রপ্তানিতে বিপদ আসতে পারে বাংলাদেশের
বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে, তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে বলে জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, তুরস্ক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, এমন দেশের ব্যাংকগুলো লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হতে পারে। এমন ঘোষণায় চিন্তিত দেশের ব্যবসায়ী মহল। পোশাক খাতসহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে জড়িত ব্যবসায়ীদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য বড় সতর্কবার্তা।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতির পর শ্রম অধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেয়া বক্তব্যটি এখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা প্রবাহের পর ঘোষিত এ স্মারক এখন উদ্যোক্তাদের নতুন করে ভীত করে তুলছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সুতরাং এ বাজারে বাণিজ্যে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি হলে সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। তাই কোনো ভাবেই যাতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কার্যকর না হয় সেটিকে এখন অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন। গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
শ্রম নীতির ৬ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, এই লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে যে, লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি এমন কোনো দেশ, অঞ্চল, সংস্থা, ব্যক্তি কিংবা জাহাজ যুক্ত থাকে, যা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, তুরস্ক কিংবা অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক সরকার ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে, তাহলে এই লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলো লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হতে পারে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতি নিয়ে অনেকের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাংলাদেশের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়নি। তবু পুরো বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি আসলাম সানি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতি শুধু আমাদের জন্য নয় সারা বিশ্বের জন্য। তবে নীতি যদি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর হয় তখন সেটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমে জানায়, ইতিমধ্যেই শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইইউ ও আইএলওর সঙ্গে বাংলাদেশের রোডম্যাপ অনুযায়ী ৮০ শতাংশের বেশি অর্জন হয়েছে। সম্প্রতি শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নেয়া উদ্যোগের বিষয়ে ইইউ প্রতিনিধিদলও সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অগ্রগতি নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শ্রমিক অধিকার রক্ষায় ইতিমধ্যে শ্রম আইন সংশোধনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এক্ষেত্রে আরও কোনো ঘাটতি রয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিজিএমইএ’র পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই নীতি কোনো ব্র্যান্ডের ওপর বা বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। ফলে আমরা এখন কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। ফলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে যাই তাহলে চিন্তার বিষয়। যখন আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটবে তখন বাইরের কোনো ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নতুন নীতি বড় উদ্বেগের। সরকার এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের আরও আগেই এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে এর সমাধান করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা পাঁচটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। চিঠিতে সম্প্রতি ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। পাঁচটি সংস্থা হলো- ফেয়ার লেবার এসোসিয়েশন (এফএলএ), আমফোরি, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ, ফেয়ার উইয়ার এবং মনডিয়াল এফএনভি। এফএলএ’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সংস্থাগুলো আড়াই হাজার বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা ও সরবরাহকারীকে প্রতিনিধিত্ব করে যারা বাংলাদেশের ২ হাজার ৯০০ কারখানা থেকে পোশাক কেনে।
নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন কোনো কোনো দেশ এখন ব্যাংক খাতের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরম সুইফট ব্যবহার করে লেনদেন করতে পারছে না। একই ধরনের বিষয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটলে তা বড় ধরনের বিপত্তি হয়ে দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) সঙ্গে লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ওএফএসি। ফলে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন মার্কিন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন নিষ্পত্তি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এসিইউ’র সদস্য হওয়ায় এ নিয়ে বিপত্তির আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশেরও। এসিইউ’র মাধ্যমে দুই মাসের জন্য ধারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্লিয়ারিং হাউজটির মাধ্যমে আমদানির দেনা পরিশোধ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।