বাড্ডায় ঈদ কার্ড পাঠিয়ে চাঁদা চাইছেন ছাত্রলীগ নেতা
- ঈদ কার্ড পাঠিয়ে তিন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের মামলা।
- ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুলিশের কাছে গেলে বিপদ বাড়ে।
‘আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও ২১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ, বাড্ডা থানা, ঢাকা মহানগর উত্তরের পক্ষ থেকে অসহায় ও পথশিশুদের মাঝে ঈদবস্ত্র বিতরণ করা হবে। উক্ত কার্যক্রমে আপনাদের একান্ত সহযোগিতা কামনা করছি।’
রাজধানীর বাড্ডা থানার ২১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইমরান ইসলাম এসব কথা লিখে ওই এলাকার ব্যবসায়ী, ভবনমালিক ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে ‘ঈদ কার্ড’ পাঠাচ্ছেন, দাবি করছেন চাঁদা।
কারও কারও কাছে ঈদ, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা অজুহাতে চাঁদা দাবি করে অপরাধী দলগুলো।
ইমরানের ‘ঈদ কার্ড’ পাঠানো প্রতিষ্ঠানের একটি ডেল্টা ভিসা সার্ভিস। ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির মালিকের কাছে দাবি করা হয় দুই লাখ টাকা। ঘটনাটিতে পুলিশ বাদী হয়ে রোববার বাড্ডা থানায় ইমরানসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে। এতে বলা হয়েছে, ইমরান ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছ থেকে এক লাখ টাকা আদায় করে নিয়েছেন। একই পরিমাণ টাকা নিয়েছেন আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
বাড্ডার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে অসহায় মানুষ ও পথশিশুদের মধ্যে ছাত্রলীগের উদ্যোগে ঈদবস্ত্র বিতরণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড্ডায় অপরাধীদের তিনটি দল দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি করে। ব্যবসায়ীদের কারও কারও কাছ থেকে মাসে মাসে টাকা নেওয়া হয়। কারও কারও কাছে ঈদ, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা অজুহাতে চাঁদা দাবি করে অপরাধী দলগুলো।
চাঁদা না দিলে কী হয় তা টের পেয়েছিলেন এসএএম অনলাইন নামের একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক মতিউর রহমান। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে হেলমেট পরা এক সন্ত্রাসী ঢুকে কোনো কথা না বলে এক কর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিটি তাঁর গায়ে লাগেনি। মাথার পাশ দিয়ে গিয়ে দেয়ালে লাগে।
গুলির ঘটনায় বাড্ডা থানায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন ব্যবসায়ী মতিউর রহমান। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, গুলির পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর মুঠোফোনে বিদেশি একটি নম্বর থেকে অডিও বার্তা পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘মতিউর সাহেব জিনিসটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। পরিবারের ওপর এখনো হামলা করিনি। পরবর্তী হামলা কিন্তু পরিবারের ওপর হয়ে যাবে। আপনাকে প্রশাসন বাঁচাবে না।’
মতিউর রহমান রোববার বলেন, সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজিতে এলাকার ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। তবে কেউ ভয়ে আইনি ব্যবস্থায় যায় না। তবে তিনি মামলা করেছেন।
ঈদ কার্ড পাঠিয়ে চাঁদাবাজির মামলায় পুলিশ ছাত্রলীগ নেতা ইমরানের এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর নাম ইমন। অন্যদিকে ইমরানকে খোঁজা হচ্ছে। বাড্ডা থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী বলেন, বাকি আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মতিউর সাহেব জিনিসটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। পরিবারের ওপর এখনো হামলা করিনি। পরবর্তী হামলা কিন্তু পরিবারের ওপর হয়ে যাবে। আপনাকে প্রশাসন বাঁচাবে না।
বিদেশে বসবাস, চাঁদাবাজি দেশে
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডায় তিনটি অপরাধী দল সক্রিয়—জিসান গ্রুপ, মেহেদী গ্রুপ এবং রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপ। তিনটি দলের ৩৫ জন সদস্যের নাম জানা গেছে, যাঁদের বেশির ভাগের নামে থানায় মামলা রয়েছে। তাঁদের কাজ মূলত চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও জমি দখলে সহায়তা করা।
জিসান পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ে থাকেন। সেখান থেকেই অপরাধী দল পরিচালনা করেন। তাঁর প্রধান সহযোগী আবুল বাসার। তিনি বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, তাদের গুলশান বিভাগে ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে বাড্ডা ও ভাটারা থানা এলাকায়।
আবুল বাসার গতকাল সোমবার কাছে দাবি করেন, তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা চাঁদাবাজিতে জড়িত না। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অবশ্য পুলিশ বলছে, আবুল বাসারের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে।
মেহেদী গ্রুপের প্রধান মেহেদী ওরফে কলিংস একসময় সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। পুলিশ সূত্র বলছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরাধী দল পরিচালনা করেন। মেহেদী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় সম্প্রতি তিনটি মামলা হয়েছে। আগের মামলাও রয়েছে।
মেহেদীর অন্যতম সহযোগী ছাত্রলীগ নেতা ইমরান, যিনি ঈদ কার্ড পাঠিয়ে চাঁদা চেয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ছাত্রলীগের পরিচয়ে ঈদ কার্ড ছাপিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে থানা ছাত্রলীগের সভাপতিকে বলা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ‘রবিন, ডালিম ও মাহবুব’ গ্রুপের তিন নেতাও মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখান থেকে অপরাধী দল পরিচালনা করেন।
বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আকাশ আহমেদ বলেন, তিনি খোঁজ নেবেন। চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলে ইমরানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ‘রবিন, ডালিম ও মাহবুব’ গ্রুপের তিন নেতাও মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখান থেকে অপরাধী দল পরিচালনা করেন।
অপরাধপ্রবণ বাড্ডা
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের মধ্যে পড়েছে বাড্ডা থানা। ওই এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি বসবাস করেন। অপরাধপ্রবণতাও বেশি। ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, তাদের গুলশান বিভাগে ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে বাড্ডা ও ভাটারা থানা এলাকায়।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাঈম আহমেদ বলেন, চাঁদাবাজি একটি ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশেরই দায়িত্ব এসব অপরাধ দমন করা।