ইউরোপের এ শহরে ‘সেলফি’ তোলার আগে ভাবুন!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, সেলফি বা অন্যান্য ছবি দেয়ার বিষয়টি অধিকাংশ জার্মান নাগরিক প্রয়োজন হিসেবে মনে করে না। রিপোর্টটিতে বলা হয়, যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবি দেয়ার মধ্যে তরুণদের (৭ শতাংশ) সংখ্যাই বেশি।
দুপুর ১টা বাজে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে; তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ক্যাফে লুজিয়ার ভেতর তখন জমজমাট অবস্থা। আশেপাশের সবাই তখন গল্পে মশগুল। প্রাণবন্ত পরিবেশ চারিদিকে। খবর বিবিসির।
সেখানে কোণার টেবিলের এক মেয়ে হাত বাড়িয়ে হুট করে বলে উঠলো, “চলো সবাই, সেলফি তুলি।”
মেয়েটি প্যারিস থেকে এসেছে। এটাই জার্মানির রাজধানী বার্লিনে তার প্রথম ঘুরতে আসা। সবাই হেসে তার সাথে ছবি উঠালো। এদের মধ্যে একজন জার্মানিতে কিছু বছর ধরে বসবাস করে। সে বললেন, “বার্লিনে কেউ তেমন একটা সেলফি বা নিজস্ব ছবি তুলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।”
বার্লিনে কিছুদিন থাকলেই অবশ্য বোঝা যায় বিষয়টি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কেউই পাবলিক প্লেসে বা প্রকাশ্যে ক্যামেরায় নিজেদের ছবি তোলে না। সেলফিকে এখানে নিজেকে খুব বেশি জাহির করা হিসেবে ধরা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোতে মানুষের ‘সেলফি’ তোলার ব্যপক প্রবণতা দেখা গেলেও বার্লিনে এর চর্চা একেবারে নেই বললেই চলে।
জার্মানবাসীরা যে তাদের ব্যক্তি জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন সেটি নতুন কিছু নয়। গোপনীয়তার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং মনোভাব নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব হোহেনহেইমের এক গবেষণায় দেখা যায়, জার্মান নাগরিকরা খুবই কম তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, সেলফি বা অন্যান্য ছবি দেয়ার বিষয়টি অধিকাংশ জার্মান নাগরিক প্রয়োজন হিসেবে মনে করে না। রিপোর্টটিতে বলা হয়, যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবি দেয়ার মধ্যে তরুণদের (৭ শতাংশ) সংখ্যাই বেশি।
২০১৭ সালের রিপোর্টটির সহ-লেখক এবং ভ্রিজ ইউনিভার্সিটি আমস্টারডম এর সহযোগী অধ্যাপক ফিলিপ মাসুর বলেন, জার্মানিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি উল্লেখ্যযোগ্যভাবে আলোচিত। তৎকালীন ইস্ট জার্মানির কারনেই এখানকার মানুষ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে বেশ তৎপর বলে জানান ফিলিপ।
১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার আগে পূর্ব বার্লিন জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (জিডিআর) এবং পশ্চিমে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির মধ্যে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে জিডিআরের নাগরিকরা, জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের (স্টাসি) দ্বারা ভয়ঙ্কর নজরদারির মধ্যে বসবাস করতেন। ইতিহাসের এসব বিষয়সহ পুঁজিবাদী বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বার্লিনবাসীর সেলফির প্রতি অনীহার তৈরি করেছে।
বার্লিনের ক্লাবগুলো থেকে ‘নো সেলফি’ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে মতামত দিয়ে নাগরিকরা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কথা মাথায় রেখে ক্লাবগুলোতে সকল প্রকার ছবি তোলা নিষিদ্ধ করেছে। এসব ক্লাবে প্রবেশ করতে হলে মোবাইল ফোন বাইরে রেখে যেতে হবে অথবা ক্যামেরা লেন্সের উপর স্টিকার দিয়ে বন্ধ করে রাখতে হবে। বার্লিনের এসব ক্লাবগুলো বিশ্বের সেরা ‘টেকনোআ’ মিউজিকের জন্য বিখ্যাত। সেই সাথে এসব ক্লাবগুলো মানুষের স্বাধীন আচার-আচরনের জন্য উন্মুক্ত স্থান। ক্লাবগুলো নানা ধরনের সংস্কৃতি উদযাপনের নিরাপদ জায়গা হিসেবেই ধরে নেয়া হয়।
এখানকার জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বারঘাইন’, ‘অ্যাবাউট ব্ল্যাঙ্ক’, ‘সিসিফাস’ এবং ‘কিটক্যাট’। ‘কিটক্যাট’ এর কর্তৃপক্ষের মতে, ছবি তোলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে মানুষ এখানে ভিন্ন ধরনের আচরণ করতো; যা ক্লাবের চিন্তাধারার সাথে মিলতো না।
পারফরম্যান্স শিল্পী মারটা লোডোলর বিগত নয় বছর ধরে বার্লিনে বসবাস করছেন। তিনি মনে করে, বার্লিন শহরের মানুষ মুক্ত চিন্তার চর্চা করে এবং তাদের কাছে ইন্টারনেট জগতের বাইরের দুনিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই শহরের নানা অংশে দেখা মেলে ক্যামেরার উপর নিষেধাজ্ঞা মূলক সাইনবোর্ড। এমনকি কনসার্টগুলোতেও বার্লিনবাসীকে তার পছন্দের শিল্পীদের ক্যামেরাবন্দি করতে দেখা যায় কম।
এ ধরণের নিষেধাজ্ঞাগুলো ছাড়াও বার্লিন শহরে এবং পুরো জার্মানি জুড়েই রয়েছে যুদ্ধের স্মৃতিস্মারক এবং এমন নানা স্থাপনা। যেমন মিট্টেতে রয়েছে ইউরোপে হত্যা করা ইহুদিদের স্মৃতিস্মারক। এসব স্থানে ছবি তোলা খুবই আপত্তিকর হিসেবে ধরা হয়।
বার্লিনে কর্মরত লন্ডনের চিত্রগ্রাহক ও ডকুমেন্টারি সিনেমা নির্মাতা ক্লডিয়া হ্যাম্পটনের মতে, লন্ডনের মতো বার্লিনে ব্যক্তিগত জীবনযাপনের চিত্রায়নকে গুরুত্ব দেয়া হয় না।
ছবি তোলার উপর এমন নিষেধাজ্ঞা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। কর্মজীবী মানুষের অনলাইনে সক্রিয় থাকার বিষয়টি এক্ষেত্রে মূল কারণ হতে পারে।
বার্লিনে পুঁজিবাদের বিপক্ষের অবস্থান পূর্বে এখানকার দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়া এবং সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে থাকলেও এর ক্রমশ পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই শহরে আবাসনখাতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে বলেও জানান লোডোলর।
মাসুরের মতে এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো বিশ্বায়ন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, বার্লিনের ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার এবং ব্যবসায়ী এমিলি স্ট্যানেসচু। তিনি প্রায়শই তার ইন্সট্রাগ্রামের ৬৪,০০০ ফলোয়ারের জন্য ‘সেলফি’ প্রকাশ করে থাকে। বার্লিনে তার নয় বছরের কর্মজীবনে, সেলফি তোলার বিষয়টি যে এখনো বার্লিনে বা জার্মানিতে ভিন্ন চোখে দেখা হয় তা তিনি লক্ষ্য করেছেন।
কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেও এমিলি তার কাজের জন্য সেলফি তুলে থাকেন। তার মতে, “তিনি কর্মজীবনের এমন পরিস্থিতিতে আছে, অন্যরা কী ভাবলো তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ নেই।”
সফলতা পাওয়ার জন্য জীবনমুখী এসব চিন্তা ভাবনাই কি পরিবর্তন আনবে মুক্তমনা এই বার্লিন শহরের?
বার্লিন শহরের মুক্তচিন্তার চর্চা মানুষকে ইন্টারনেট দুনিয়ার বাইরে রেখে জীবন উপভোগ করতে শেখায়। অনলাইন জগতের অদৃশ্য চাপের বাইরে থেকে নিজস্ব জীবনে স্মৃতি তৈরির চর্চা করতে বলে শহরটি।