International

ইরাকের কুয়েত আক্রমণের খবর জেনেও উড়োজাহাজের অবতরণ, ৩৪ বছর পর মামলা

১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণ করে ইরাক। তখন ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। এ সময় কয়েক শ যাত্রীবাহী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজ জিম্মি করা হয় কুয়েতে। সেই উড়োজাহাজে থাকা যাত্রী ও ক্রুদের ব্যবহার করা হয় ‘মানবঢাল’ হিসেবে। এই ঘটনার ৩৪ বছর পরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং যুক্তরাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করছেন সেই ফ্লাইটের যাত্রী ও ক্রুরা।

জিম্মি যাত্রী ও ক্রুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। মামলায় তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের বহনকারী উড়োজাহাজটি কুয়েতে অবতরণ করার কয়েক ঘণ্টা আগেই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও যুক্তরাজ্য সরকার জানতে পেরেছিল কুয়েতে ইরাক সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছে। তাঁদের আরও দাবি, যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত ও গোপনে সেনা মোতায়েনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ফ্লাইট। গোপনে ওই ফ্লাইটে করে বিশেষ অভিযান চালাতে সক্ষম এমন একদল সেনা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কুয়েতে। এ ক্ষেত্রে উড়োজাহাজে থাকা বেসামরিক লোকজনের ঝুঁকির বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যেই নেওয়া হয়নি।

ঘটনাটি ১৯৯০ সালের ২ আগস্টের। এদিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি যাচ্ছিল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে। যাত্রী ছিলেন ৩৬৭ জন। ১৮ জন ছিলেন ক্রু সদস্য। মাঝপথের নির্ধারিত যাত্রাবিরতির অংশ হিসেবে কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল উড়োজাহাজটি। এটি ছিল সেখানে অবতরণ করা শেষ বাণিজ্যিক ফ্লাইট। এই সময় কুয়েত আক্রমণ করে ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী।

এরপর প্রায় পাঁচ মাস উড়োজাহাজটির যাত্রী ও ক্রুদের জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। এ সময় তাঁদের ওপর চলে নানা ধরনের নির্যাতন। ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয় তাঁদের।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভস থেকে এ-সংক্রান্ত নথি প্রকাশিত হওয়ার পর জানা যায়, সেই ফ্লাইটটি অবতরণের আগে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের খবর পেয়েছিলেন কুয়েতে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। বিষয়টি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগেই জানিয়ে সতর্কও করেছিলেন তিনি। ২০২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রদূতের সতর্ক করার বিষয়টি কয়েক দশক ধরে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার।

লিজ ট্রাস বলেছিলেন, কুয়েত আক্রমণের খবর জানতে পারলেও তখন তা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজকে জানায়নি পররাষ্ট্র দপ্তর। ওই ফ্লাইটে বিশেষ বাহিনীর সেনাদের গোপনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন তখন যাত্রীবাহী একটি ফ্লাইটকে এ ধরনের কোনো কাজে ব্যবহার করতে চায়নি সরকার।’ তবে মামলাকারী যাত্রী ও ক্রুদের আইনজীবীরা বলছেন, কুয়েত আক্রমণের খবরটি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জানত এবং সেই ফ্লাইটে গোপনে বিশেষ বাহিনীর একদল সেনাকে কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সেই ফ্লাইটের কেবিন ক্রুদের মধ্যে একজন ছিলেন নিকোলা ডাউলিং (৫৬)। কুয়েতে জিম্মিদশায় প্রায় দুই মাস থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এ সময়ে তাঁকে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

নিকোলা বলেন, ‘সব জেনেও এত বছর ধরে ন্যায়বিচারের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া জঘন্য একটি কাজ। সাদ্দাম হোসেন নারী ও শিশুদের আড়ালে লুকিয়ে আছেন—এমন কথা বলাটা মার্গারেট থেচারের (তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) জন্য খুবই ভালো ছিল। তিনি জেনেবুঝেই আমাদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এ জন্য সাদ্দাম হোসেন ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো তিনিও সমান দায়ী।’

দেড় বছর আগে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে যোগ দেওয়া ২৩ বছর বয়সী ক্রু নিকোলাকে মানববর্ম হিসেবে পাঠানো হয় একটি সেনা শিবিরে। নিকোলা বলেন, ‘এক মরুভূমির মাঝখানে গিয়ে তারা থামে। বাসে থাকা সেনারা আমাদের বাস ঘিরে ফেলে জানালা দিয়ে বন্দুক তাক করে। চারদিকে তখন পিনপতন নীরবতা। শিশুরা পর্যন্ত কান্না বন্ধ করছিল না। আমাদের তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাদের গুলি করা হবে। মনে করেছিলাম এটা প্রতিশোধের শুরু। কিন্তু গুলি শেষ পর্যন্ত হয়নি। আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি কেন মরুভূমির মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে তারা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করেছিল।’

সেই শিবিরে প্রবাসী ব্রিটিশ নাগরিকদেরও আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানান নিকোলা। তিনি বলেন, শিবিরের পরিস্থিতি ছিল অমানবিক ও ভয়ংকর। যত্রতত্র মলমূত্র পড়ে ছিল। পানি ও খাবার তেমন ছিল না। কারও না কারও ডায়রিয়া লেগেই থাকত।

তাঁকে যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের আচরণে চরম হতাশ হয়েছেন বলে জানান নিকোলা। বলেন, মুক্তি পাওয়ার পর দ্রুত কাজে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হতে থাকে। এর কারণ হিসেবে কেবিন ক্রুর সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যে আবারও ফ্লাইট পরিচালনা শুরুর কথা বলা হয়েছিল। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইটের দায়িত্ব না দিতে বারবার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি।

নিকোলা বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানলে চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তাই বাধ্য হয়ে কাজে যোগ দেন। এরপর ১৫ বছর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে ছিলেন। প্রতি মাসেই একবার করে মধ্যপ্রাচ্য যেতে হতো। সেই ফ্লাইটে থাকা সহকর্মীদের অনেকের মতো ‘মেডিকেল পেনশনে’ অবসরে গিয়েছিলেন তিনি। সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিকোলা বললেন, ‘এটা ছিল অত্যাচার।’

নিকোলা জানান, দায়িত্বে অবহেলা ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিরুদ্ধে সেই ফ্লাইটের ৯৫ জন যাত্রী ও কেবিন ক্রু মামলা করেছেন। এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতেই এই মামলা করেছেন জানিয়ে নিকোলা বলেন, ‘এই ঘটনা আমার জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor