Bangladesh

এই নির্বাচনে খরচ ১৪৪৫ কোটি

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত রবিবার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এবং ১৪-দলীয় জোটের মধ্যে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। ফলে রাজনীতির মাঠে আরেক বড় দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছে। ফলাফলও প্রায় চূড়ান্তই বলা যায়। এ অবস্থায় নির্বাচনে এত বড় ব্যয়ের যৌক্তিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, এই সমঝোতার নির্বাচনে এত খরচ অর্থহীন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। তবে আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে এ ব্যয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে; যা ২০১৮ সালের নির্বাচনী ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। এবার প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের দুই দিনের সম্মানী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগে তাদের এক দিনের ভাতা দেওয়া হতো। পাশাপাশি জ্বালানি খরচও এবার বেড়েছে। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন ৯ লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভাতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। এর বাইরে নির্বাচনী প্রশিক্ষণে খরচ ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। বাজেটে প্রায় ৬০ শতাংশ খরচ ধরা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে। এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৪৭ আসনে ভোট হয়) খরচ হয়েছিল ২৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের খরচের কি খুব প্রয়োজন ছিল? এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সাজানো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না এটাই স্বাভাবিক। যথার্থ নির্বাচন হতে হলে সেখানে প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। এখন যে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু সেটা তথাকথিত প্রতিযোগিতা। ফলে এখন নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে তা নির্বাচনী গ্রামারে পড়ে না। এটি একটি নির্বাচন নির্বাচন খেলা। তাই এই নির্বাচনে যে খরচ হচ্ছে তা অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। যাদের উপকার হবে তাদের জন্য আকর্ষণীয়, কিন্তু জাতির জন্য অপচয়। এ খেলায় খরচ করা রাষ্ট্রের অপচয় ছাড়া কিছুই না।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচন একটি আনুষ্ঠানিক বিষয়। এর কিছু প্রক্রিয়া আছে। এবারের নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। এ জন্য আগামী ৭ তারিখ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এ কারণে বলছি, ধরুন কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলো, তাহলে সেখানে নির্বাচন হবে না। তাই শেষ পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয় আছে। এই নির্বাচনে যে ব্যয় হবে তা জনগণের করের টাকা। এখানে কোনো বৈদেশিক সাহায্য নেই; অর্থাৎ গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যা ব্যয় হচ্ছে তা জনগণের টাকা। ফলে জনগণকেই বিচার করতে হবে এই নির্বাচনে যেটা ব্যয় হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে কি না।’

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছে; বিশেষ করে রাজনীতির মাঠে বড় দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কমিশনের চেষ্টা ছিল। গত জুনে চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় কমিশন সরকারের কাছে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট চায়।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালনা ব্যয় ২ হাজার ১২৪ কোটি এবং উন্নয়ন ব্যয় ২৮২ কোটি টাকা। এই বাজেটের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। তবে কমিশন মনে করে, এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে। এ কারণে গত ১ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় নির্বাচনী ব্যয়ের বিষয়টি হিসাব করে মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় নির্বাচন কমিশনের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ নির্বাচন খাতে অর্থ বাড়াতে হবে।

নির্বাচনী ব্যয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে; যা নির্বাচনে প্রাক-বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এদিকে নির্বাচনে দায়িত্বপালনের সময়কার ব্যয় মেটাতে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রায় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী। এর মধ্যে পুলিশ ৪০০ কোটি, আনসার ও ভিডিপি ৩৬৬ কোটি, বিজিবি ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ, র‌্যাব ৫০ কোটি ৬৩ লাখ ও কোস্টগার্ড চেয়েছে ৭৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এমন চাহিদার বিপরীতে কত দিনের জন্য নির্বাচনী এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষায় বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন, সেটি বিবেচনা করে বরাবরের মতো অর্থ বরাদ্দ দেবে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়ের খাত থেকে এসব ব্যয় মেটানো হবে। প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে নতুন অর্থ বরাদ্দ চাওয়ার সুযোগ রয়েছে ইসির।

ইসি সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে যে পরিমাণ টাকার চাহিদা দেওয়া হয়, সাধারণত তা পুরোপুরি দেওয়া হয় না। নির্বাচনে কোন বাহিনীর কতসংখ্যক সদস্য কয়দিন মাঠে থাকবেন, তার ওপর ভিত্তি করে টাকা বরাদ্দের পরিমাণ ঠিক করা হয়। গত নির্বাচনেও তাই হয়েছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৬ জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাসদস্যরা ছিল টহলে। ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকে ১০ দিনের জন্য মোতায়েন ছিল সশস্ত্র বাহিনী। এবার ইসি ভোটের মাঠে ১৩ দিনের জন্য সেনা মোতায়েন চায়। ইতিমধ্যে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণের ১৫ দিন পর পর্যন্ত মাঠে পুলিশ টহল রাখতে চায় ইসি। আইনশৃঙ্খলা খাতে খরচ বাড়ার এটিও একটি কারণ।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন খাতের ব্যয়ও বাড়বে। প্রায় ৯ লাখ প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের ভোটগ্রহণের ভাতা বাবদ গত নির্বাচনের চেয়ে এবার বেশি দিতে পারে ইসি। প্রায় ১২ কোটি ভোটারের এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে কেন্দ্র থাকবে ৪২ হাজারের বেশি। 

আগের কোন নির্বাচনে কত ব্যয়

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য মোট ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে তা আরও বেড়েছিল।

দশম সংসদ নির্বাচন : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনায় ৮১ কোটি ৫৫ লাখ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয় ১৮৩ কোটি টাকা। এই নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট হয়, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একক প্রার্থীরা। অর্ধেক এলাকায় ভোট করতে হওয়ায় বরাদ্দের তুলনায় খরচ অনেক কমে আসে।

নবম সংসদ নির্বাচন : ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়; যাতে ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি। উপকরণ, ব্যবস্থাপনাসহ সব খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে নির্বাচনী বরাদ্দও বাড়ে।

অষ্টম সংসদ নির্বাচন : মোট ব্যয় হয় ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

সপ্তম সংসদ নির্বাচন : পরিচালনা বাবদ ব্যয় ১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন : মোট ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচন : পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় হয় ২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

চতুর্থ সংসদ নির্বাচন : ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

তৃতীয় সংসদ নির্বাচন : ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন : ব্যয় হয় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

প্রথম সংসদ নির্বাচন : ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ৬৪২ জন ভোটারের এ নির্বাচনে ব্যয় ছিল ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button