একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলেই দিতে হবে পরিবেশ কর
ব্যক্তিগত মোটরযানের ওপর নতুন আরোপিত পরিবেশ সারচার্জ কাটবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। মোটরযানের ফিটনেস রেজিস্ট্রেশন বা পুনঃনিবন্ধন ফির পাশাপাশি এখন এই চার্জ দিতে হবে গাড়ির মালিককে। কত টাকা দিতে হবে তা নির্ভর করবে একই মালিকের কতটি গাড়ি আছে ও সেগুলো কত সিসির, তার ওপর। ব্যক্তিগত মোটরযান বলতে মূলত প্রাইভেটকার, জিপ ও মাইক্রোবাসকে বোঝানো হয়েছে।
গত ১৩ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে বিআরটিএকে পরিবেশ সারচার্জ কাটার নির্দেশ দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি বছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো ব্যক্তিগত গাড়িতে আরোপ হয়েছে সারচার্জ। বৈদ্যুতিক গাড়িও থাকছে এর আওতায়।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, পরিবেশগত সারচার্জ বা পরিবেশ কর অন্য কোনো করের সঙ্গে সামঞ্জস্যযোগ্য নয়। যদি কোনো করদাতার কাছে বিআরটিএ থেকে একাধিক বছর ধরে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই আয়কর রিটার্নসহ পরিবেশগত সারচার্জ যুগ্ম কর কমিশনারের কাছে জমা দিতে হবে।
‘একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে যে গাড়ির ওপর সর্বনিম্ন হারে পরিবেশ সারচার্জ আরোপিত হবে সে গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির বিপরীতে পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাস, মিনিবাস, কোস্টার, প্রাইম মুভার, ট্রাক, লরি, ট্যাংক লরি, পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ব্যতীত অন্য মোটরযান এই সারচার্জের অন্তর্ভুক্ত হবে। একাধিক বছরের জন্য গাড়ির নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগে পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় উপ-কর কমিশনার আয়কর রিটার্ন প্রসেস বা কর নির্ধারণকালে তা আদায় করবেন।’
পরিপত্র অনুযায়ী, একাধিক বছরের জন্য গাড়ির নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়ন করা হলে যে অর্থবর্ষে গাড়ির নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়ন করা হয়েছে তার পরবর্তী অর্থবর্ষগুলোর ৩০ জুন তারিখের মধ্যে প্রযোজ্য হারে পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে।
কোন গাড়ির কত সারচার্জ
>>১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট পর্যন্ত প্রতিটি মোটরগাড়ির জন্য ২৫ হাজার টাকা।
>>১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াটের অধিক কিন্তু ২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াটের অধিক নয় এমন প্রতিটি মোটরগাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা।
>>২০০০ সিসি বা ১০০ কিলোওয়াটের অধিক কিন্তু ২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াটের অধিক নয় এমন এমন প্রতিটি গাড়ির জন্য ৭৫ হাজার টাকা।
>>২৫০০ সিসি বা ১২৫ কিলোওয়াটের অধিক কিন্তু ৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াটের অধিক নয় এমন প্রতিটি মোটরগাড়ির জন্য
১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
>>৩০০০ সিসি বা ১৫০ কিলোওয়াটের অধিক কিন্তু ৩৫০০ সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের অধিক নয় এমন প্রতিটি মোটরগাড়ির জন্য ২ লাখ টাকা।
>>৩৫০০ সিসি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের অধিক এমন প্রতিটি মোটরগাড়ির জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিসেস সুনেহরাহ কামালের ১৫০০ সিসির একটি সেডান গাড়ি এবং ১৭৫ কিলোওয়াটের একটি টেসলা গাড়ি রয়েছে। এক্ষেত্রে দুটো গাড়ির জন্যই কি পরিবেশ সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে? গাড়ির ফিটনেস নবায়নকালে নবায়নকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পরিবেশ সারচার্জ বাবদ কত টাকা এ-চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে?
এমন প্রশ্নের উত্তর হলো, কোনো করদাতার একাধিক গাড়ি থাকলে একের অধিক যতটি গাড়ি থাকবে ততটি গাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে। সুনেহরাহ কামালের দুটো গাড়ি রয়েছে। একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে যে গাড়ির ওপর সর্বনিম্ন হারে পরিবেশ সারচার্জ আরোপিত হতে পারে ওই গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির জন্য প্রযোজ্যহারে পরিবেশ সারচার্জ প্রদেয় হবে। তার ১৫০০ সিসির একটি সেডান গাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা এবং ১৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জ দুই লাখ টাকা।
এ দুটি গাড়ির মধ্যে ২৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির জন্য পরিবেশ সারচার্জ দুই লাখ টাকা বা অধিক হওয়ায় পরিবেশ সারচার্জ বাবদ দুই লাখ টাকা প্রদেয় হবে। এ-চালানের মাধ্যমে সারচার্জের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করে, এ-চালানের কপি গাড়ির ফিটনেস নবায়নকারী কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হবে।
পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশের এই সারচার্জ আদায় করে তা গণপরিবহনে বিনিয়োগ করলে মানুষের ভোগান্তি কমবে, সুরক্ষা পাবে প্রাণ ও প্রকৃতি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা পেয়েছি। তবে কোন কোডে এটা নেওয়া হবে সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। আইবাস, কর অঞ্চল ও এনবিআরে তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠান আলাদা কোডে সারচার্জ নিতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এছাড়া এনবিআরকেও চিঠি দিয়ে নির্দেশনা চেয়েছি। নির্দেশনা পেলে আমরা সারচার্জ নেওয়া শুরু করবো।’
আয়কর আইনজীবী আবদুর রহমান মাসুম বলেন, ‘পরিবেশ সারচার্জের বিষয়টা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদীদের দাবি ছিল। এটা বাস্তবায়ন হলে শহরে গাড়ির চাপ কিছুটা কমবে। মানুষের ভোগান্তিও কিছুটা লাঘব হবে।’
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘কার্বন করকে যদি পরিবেশ উন্নয়নে খরচ না করা হয় তাহলে মানুষ সুফল পাবে না। যে উদ্দেশ্যে করটা আরোপ করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এই করের উদ্দেশ্য হলো সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ কমানো ও মানুষকে গণপরিবহনে আকৃষ্ট করা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি গণপরিবহনে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ গাড়িরই ফিটনেস নেই। গণপরিবহনে এখন নজর দিতে হবে। কার্বন করটা নিয়ে তা বিনিয়োগ করতে হবে গণপরিবহনে। তাহলেই এই কর আরোপের সুফল সর্বস্তরের মানুষ ভোগ করবে।’