Bangladesh

এডিস-কিউলেক্সের দাপট অসহায় রাজধানীবাসী

বরাদ্দের শতকোটি টাকা কোথায় যায় প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের * প্রজননের উৎস বন্ধে কাজ করার পরামর্শ, ঝিমিয়ে পড়েছে দুই সিটির মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম

প্রকৃতিতে শীতের আমেজ বিরাজ করছে। এই আবহাওয়ায় এডিস মশা প্রজনন শূন্যে নামার কথা থাকলেও ডেঙ্গু আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখনো দৈনিক গড়ে চার থেকে পাঁচজন মানুষ মারা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি উপদ্রব বেড়েছে কিউলেক্স মশার। ঘরে বাইরে কিউলেক্স মশার উৎপাতে স্থির থাকা যাচ্ছে না। এডিস-কিউলেক্স-এই দুই মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরের মানুষ। এমন নাজুক অবস্থায়ও মশা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকার দুই সিটির কার্যক্রমে কোনো গতি নেই বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী ও কীটতত্ত্ববিদরা।

কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ১৬ প্রজাতির মশা। এর ভেতর কিউলেক্স মশা ৯০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে থাকে এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া এবং অন্যান্য মশা। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কিউলেক্সর প্রজনন বাড়তে থাকে। সে হিসাবে এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম চলছে। নগরীর খাল-নদী, ডোবা-নালা এবং জমে থাকা গভীর নর্দমায় প্রজনন ঘটাচ্ছে এই মশা। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না করায় জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কিউলেক্স।

কীটতত্ত্ববিদরা জানান, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা বিস্তার লাভ করেছে সারা বছর। পাশাপাশি অক্টোবর থেকে কিউলেক্সের উপদ্রব বেড়েছে। এখন নগরজুড়ে কিউলেক্স মশার উপদ্রবে মানুষ ‘চরম বিরক্তি’র মধ্যে রয়েছে। চলতি ও আগামী মাসে মশার উপদ্রব আরও বাড়বে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে কিউলেক্স পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

তারা আরও জানান, এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ অতি সতর্ক থাকে। কিউলেক্সের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। দেশের ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার এই প্রজাতি ফাইলেরিয়া বা গোঁদরোগের জীবাণু বহন করে। এ ছাড়াও কিউলেক্স মশার কামড়ে চর্মরোগও হয়ে থাকে। আর এই মশার ‘গুন গুন শব্দ’ ও কামড়ে চরম বিরক্তিও সৃষ্টি করে থাকে। বেশি উপদ্রবের সময় স্বস্তিতে কোনো কাজ করতে পারে না মানুষ। নগরবাসীকে রোগব্যাধি ও অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

কিউলেক্স কোথায় জন্মায় : দূষিত ও বদ্ধ জলাশয়গুলো মূলত ঢাকার কিউলেক্স প্রজননের প্রধান উৎসস্থল। ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার বদ্ধ নর্দমা, খাল, ডোবা ও নদী কিউলেক্স মশার প্রজননের বড় উৎস। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদের দূষিত পানিতেও বিপুল পরিমাণ কিউলেক্স মশার প্রজনন ঘটছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যখন যে কাজ করা দরকার, সেটা করে না। যেভাবে করা দরকার, সেভাবে করে না। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ফগিং করে নগরবাসীর মন ভোলানোর চেষ্টা করে। বাস্তবে সিটি করপোরেশনে লোক দেখানো কাজে তাদের কোনো উপকার হয় না।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, কিউলেক্স মশার ৯৫ ভাগ প্রজনন উৎস ডোবা, নালা ও জলাশয়। এ সবের বেশির ভাগের মালিকানা সরকারি সংস্থা। সিটি করপোরেশনকে নেতৃত্ব দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা চালাতে দেখা যায় না। মেয়ররা সাংবাদিকদের ডেকে লোক দেখানো কিছু কাজ করতেন, বাস্তবে তাতে কাজের কাজ কিছু হতো না। আর এখনকার প্রশাসকরাও মশার ব্যাপারে তেমন কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছেন না।

দুই সিটির লোক দেখানো তৎপরতা : এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় কমছে না মশার উপদ্রব। বছরজুড়ে বিস্তার লাভ করা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সংস্থার ব্যর্থতা সবার কাছে পরিষ্কার। কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। অথচ এ খাতে বছরে গড়ে শতকোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।

দুই নগর সংস্থা বলছে, প্রতিদিন সকাল ও বিকালে মশা নিয়ন্ত্রণে তারা কীটনাশক ব্যবহার করছেন। লার্ভা নিধনে সকালে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। আর বড় মশা নিধনে বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি জলাভূমি পরিষ্কারেও তারা নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে ভিন্ন কথা বলছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তাদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। প্রজনন মৌসুম বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দুই সিটির কার্যক্রমে তার বড় ঘাটতি রয়েছে।

রাজধানীর কাজীপাড়ার বাসিন্দা হামিদুর রহমান যুগান্তরকে জানান, আগে ছয়তলার থাকতেন। এখন তিনতলায় থাকেন। গত এক মাস ধরে তার বাসায় মশার ব্যাপক উপদ্রব বেড়েছে। এতে দিন কী রাত কয়েল না জ্বালিয়ে বসতেও পারছেন না। কিউলেক্স মশার উপদ্রবে রীতিমতো শঙ্কায় পড়েছেন বলে জানান তিনি।

একই রকম কথা জানান মতিঝিলের বাসিন্দা মনির হোসেনও। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছাকাছি এলাকায় তার বাসা। ওই এলাকায় প্রচুর মানুষ এডিসবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এই বছরে। নতুন করে কিউলেক্স মশার দাপটে অতিষ্ঠ তারা। ভুক্তভোগী এই বাসিন্দার অভিমত, সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় যদি মশা না মরে তাহলে এসব করে লাভ কী। শুধু শুধু সরকারি অর্থের অপচয়; এসব করে দুর্নীতিবাজরা পকেট ভারী করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত : কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এখনো এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে দৈনিক গড়ে চার থেকে পাঁচজন মানুষ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কিউলেক্সের উপদ্রব ভয়াবহরূপে বেড়েছে। দুই মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নগরবাসী।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ওষুধ ব্যবহার করছে না। বিপুল অর্থ খরচ করে দুই সিটি যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে, তাতে মশা মরছে না। এ খাতে বরাদ্দের শতকোটি টাকা কোথায় যাচ্ছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এ বিষয় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগকে নতুন করে ভাবতে হবে। সঠিক উপায় খুঁজে বের করে সে পথে অর্থ খরচ করতে হবে।

তিনি জানান, নগরীতে অনেক গভীর নর্দমা করা হয়েছে। যেখানে পানির প্রবাহ নেই। আবার অনেক কার্পেটিং করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে নগরীর ডোবা, নালা, খাল ও জলাশয়গুলো পরিষ্কার করা হয় না। এসব জলাশয় কিউলেক্স প্রজননের বড় উৎস। এখন ঢাকার চারপাশের নদ-নদীতেও মশার প্রজনন ঘটছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণ কাজ সঠিক নিয়মে চলছে না। এটা বারবার বলা হলেও সিটি করপোরেশন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো কাজ করে চলেছে। এতে যা হবার তাই হচ্ছে।

তিনি বলেন, দূষিত পানি ও বদ্ধ জলাশয়ে কিউলেক্স প্রজননের বড় উৎস। ঢাকায় তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গায় প্রচুর কিউলেক্স মশার জন্ম হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে দুই সিটির বদ্ধ নর্দমা ও নগরীর অপরিষ্কার জলাশয়গুলো। কিউলেক্স মশার এসব উৎস বন্ধে কর্তৃপক্ষকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তিনি জানান, কিউলেক্স মশার কামড়ে গোঁদরোগ হয়ে থাকে। এই রোগের ঝুঁকি কম থাকলেও কিউলেক্স চরম বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে নগরবাসীর। সেজন্য কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির যুগান্তরকে বলেন, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ডোবা, নালা ও অন্যান্য উৎসে মশার প্রজনন রোধে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করি কিউলেক্স পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে সংকট হলো-এই সময়ে এডিসের প্রজনন বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এজন্য কিউলেক্স ও এডিস দুই ধরনের মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমদাদুল হক বলেন, এডিসের উপদ্রব চলছে। এরই মধ্যে কিউলেক্স অতিমাত্রায় বেড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন রুটিন কাজের পাশাপাশি বিশেষ তৎপরতাও শুরু করেছে। প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button