Hot

ওদের ঘামে রাষ্ট্র বদলায় সংসার বদলায়: পরিবর্তনের নায়ক

মাদারীপুরের চরলক্ষ্মীপুরের মাহাবুবুল ইসলাম। পরিবার নিয়ে টিনের ঘরে বসবাস করতেন। কৃষক বাবার আয়েই চলতো পুরো পরিবার। দারিদ্র্যতার কারণে লেখাপড়ায় বেশিদূর যেতে পারেননি মাহাবুবুল। স্বপ্ন দেখেছিলেন ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর। স্বপ্ন পূরণে জীবনকে ঠেলে দিয়েছিলেন এক অজানা গন্তব্যে। গোছানো অর্থ আর জমিজমা বিক্রি করে ইউরোপ যেতে বেছে নিয়েছিলেন ভূমধ্যসাগারের ভয়ঙ্কর পথ। মাহাবুবুল জানিয়েছেন, শুরুতে ভিসা করে ঢাকা থেকে লিবিয়া গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে সাগর পথে ইতালির জন্য রওনা দেন। যাত্রাপথে ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে।

একমাস জেলও খেটেছেন। হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। পরে দালালের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খরচ করে জেল থেকে ছাড়া পান। একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশে ফেরার। কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে পারেননি। ফের সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যান। বর্তমানে মাহাবুবুলের কর্মসংস্থান দেশটির আরবিনো শহরে। তীব্র গরমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছেন তিনি। মা-বাবার মুখে হাসি দেখার জন্যই তার এই পরিশ্রম।

ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতিমাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা রেমিট্যান্স পাঠান মাহাবুবুল। সেই টাকায় দেশে স্বাচ্ছন্দে চলে তার পরিবার। মাহাবুবুলের মতো লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন। দেশে পাঠাচ্ছেন মিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স। দেশের পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছেন এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত দুই দশকে বিদেশে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ২৪ হাজার মানুষের। তাদের মাধ্যমে এই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ২৮ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিএমইটি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে বিদেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান বাড়তে শুরু করে। একই সময় থেকে বাড়তে থাকে প্রবাসী আয়ও। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিদেশে কর্মসংস্থানের নজির ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে আগের বছরগুলোর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। বছর দু’টিতে যথাক্রমে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন ও ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জনের কর্মসংস্থান হয় বিভিন্ন দেশে। এরপরের দুই বছর আবার অর্ধেকের নিচে নামে বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যা। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বিদেশে কর্মসংস্থানে বড় ধাক্কা খায়। বছরটিতে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। তবে এরপরের বছরগুলোতে ফের ধারাবাহিক বাড়তে থাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যা। বিশেষ করে গেল দু’বছর অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিদেশে যথাক্রমে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন ও ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন বাংলাদেশির বিদেশে কর্মসংস্থান হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বিদেশে কর্মসংস্থান নেয়া রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় ভর করে সরকারের আমদানি ব্যয় মেটানো ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় ভূমিকা রাখে। অবশ্য ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসায় এই ভূমিকা বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবেও দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

ফ্রান্স প্রবাসী জাকির আহমেদ চৌধুরী এক বছর ধরে বিদেশে থাকছেন। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। প্রতিমাসেই ব্যাংকিং চ্যানেলে সিলেটে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। জাকির বলেন, প্রতিমাসেই ব্যাংকে এক লাখ টাকা করে পাঠাচ্ছি। জরুরি প্রয়োজন হলে মুঠোফোন ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাই। এখন তো দেশের রিজার্ভ সংকট চলছে। ব্যাংকে টাকা পাঠালে দেশের রিজার্ভ বাড়ে। তাই ব্যাংকেই পাঠাই। দেলোয়ার হোসেন রাসেল নামের লন্ডন প্রবাসী বলেন, আমরা পরিবারের সবাই লন্ডনেই থাকি। দেশে দুই ভাই রয়েছে। আমাদের এখানে যা খরচ হয় তা বাদ দিয়ে দুই ভাইয়ের জন্য যখন যা প্রয়োজন হয় ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করি। 

মোবারক হোসেনের বাবা তিন দশক ধরে সৌদি আরবে থাকেন। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করেন। দুই ভাই ও মা নিয়ে মোবারক নরসিংদীর মনোহরদীতে থাকেন। তিনি বলেন, বাবা আগে কৃষি কাজ করতো। তখন কিছুটা অসচ্ছলতা ছিল। বাবা এখন বিদেশে চাকরি করছে। প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাঠাচ্ছে। গ্রামে এই টাকায় অনায়াসে সংসার চালানো যায়। আমিও বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি যেতে পারলে বাবাকে বিশ্রাম দেবো। প্রবাসী মিরাজুল মোল্লার বাবা আইয়ুব মোল্লা। মাদারীপুরের বাসিন্দা তিনি। সন্তানকে ঋণ করে দু’বছর আগে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এখন রয়েছেন লিবিয়ায়। ইউরোপে যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। তবে ধরা খেয়ে জেল খেটেছেন। এখন লিবিয়াতেই কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছেন। প্রতিমাসে মিরাজ যে রেমিট্যান্স পাঠান তা দিয়েই তাদের সংসার চলছে। আইয়ুব মোল্লা বলেন, ছেলে দেশে থাকতে একটা দোকানে চাকরি করতো। সেই বেতনে সংসার চালানো কঠিন ছিল। সুদের উপর টাকা এনে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি। এখন কিস্তির টাকা দেয়া শেষ পর্যায়ে। ভালোমতো সংসারও চলছে। কিস্তি শেষ হলে সংসার আরও ভালোভাবে চলবে।

অলক চন্দ্র বর্মণ মালয়শিয়ায় কাজ করছেন। তার দুই সন্তান ও স্ত্রী গাইবান্ধায় থাকেন। বড় ছেলে অভিলাষ চন্দ্র বর্মণ দশম শ্রেণিতে পড়ালেখা করেন। তিনি বলেন, বাবা মালয়শিয়ায় পামওয়েল  ফার্মে কাজ করেন। প্রতিমাসে আমাদেরকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পাঠাচ্ছেন। আমাদের পরিবারে খরচও কম। ছোট বোন এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। আমরা ভালোভাবেই চলছি। সৌদি আরবের দাম্মাম শহরে থাকেন সিয়াম আহমেদ। পাঁচ বছর হলো বিদেশ গিয়েছেন। তার মা সৈয়দা শিরিন সুলতানা বলেন, ছেলের টাকাতেই আমরা চলছি। মাসে কখনো এক লাখ আবার কখনো ৭০-৮০ হাজার টাকা পাঠায়। যখন যা লাগে। ছেলের টাকা দিয়া একটা বাড়ি করছি। সেখানে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হইছে। এখন ভালোভাবেই চলছি।

বিএমইটি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, বিদেশে কর্মসংস্থানের সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়েছে গত দুই দশকে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়কালে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। গেল ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৮ হাজার ৩৫৪ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৫২ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে ২২ হাজার ৭০ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ২১ হাজার ২৮৫ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার ও ২০২৩ সালে পাঠিয়েছেন ২১ হাজার ৯৪২ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

দেশের উন্নতির পেছনে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, উন্নতির পিছনে আমরা পণ্য ও সেবার কথা উল্লেখ করতে পারি। সেবার ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমশক্তির কথা আসে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য স্থিতিশীল রাখার জন্য যে অবদান; তার ৫০ শতাংশ রাখে আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধারা। আমরা শুধুমাত্র হাইলাইটস করি ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। কিন্তু যদি প্রকৃত হিসাব করা হয় তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি থেকে মূল্য সংযোজন করে যে পরিমাণ আয় হয় রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের থেকেও প্রায় একই পরিমাণ আয় হবে।

অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশে যে পরিমাণে রেমিট্যান্স আসে তা আমাদের তহবিলের হিসাবে যুক্ত হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে আমরা তা দেখতে পারি না। বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের ৬০ শতাংশ অবৈধ চ্যানেলে আসে। অর্থাৎ বৃহৎ একটা অংশ আমাদের হিসাবে (রিজার্ভে) যোগ হচ্ছে না। এটা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে হিসাবে যুক্ত হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে যদি এটা যুক্ত করা যায় তাহলে তৈরি পোশাক শিল্প যা অবদান রাখে তারচেয়ে বেশি অবদান রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মাধ্যমে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রেমিট্যান্স সরকারের কোনো আয় না। এর বিপরীতে সরকারকে টাকা দিতে হয়। এই টাকা পরিবারের কাছে গেলে তারা এটা দিয়ে বিনিয়োগ করে। সেটা অর্থনীতিতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ও বিনিয়োগে অবদান রাখে। আমদানি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ডলারের প্রয়োজন হয়। তখন রেমিট্যান্সের মাধ্যমে রিজার্ভে যে ডলার আসে সেটা সরকারের কাজে লাগে। এ ছাড়া এই মানুষগুলো দেশে থাকলে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হতো। তারা বিদেশে গিয়ে সরকারের কর্মসংস্থানের চাপ কমিয়ে দিচ্ছেন। দেশে থাকলে তাদের বিভিন্ন চাহিদা থাকতো। এগুলোও সরকারের লাগছে না। এক্ষেত্রেও তারা  ভূমিকা রাখছেন। দেশের শ্রমবাজারের চাপ কমাচ্ছেন। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button