Bangladesh

কঠোর আইনের পরেও হেফাজতে মৃত্যু থামছে না কেন?

নিরাপত্তা হেফাজতে কোনো নাগরিকের নির্যাতন বা মৃত্যু হলেও কতজন ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার মামলা করে কিংবা মামলা করার সাহস পায়?

২০১৩ সালে নবম সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী যখন বেসরকারি বিল হিসেবে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ উত্থাপন করেন, তখন এ নিয়ে সংসদ বিটে কাজ করা সাংবাদিকদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছিল যে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল কেন একজন সাধারণ সদস্য উত্থাপন করলেন? কেননা বেসরকারি বিল সাধারণত সংসদে পাস হয় না।

প্রসঙ্গত, দুটি পদ্ধতিতে সংসদে বিল আনা যায়।

১. সরকারি বিল: যেটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী উত্থাপন করেন।

২. বেসরকারি বিল: যেটি মন্ত্রী ছাড়া অন্য সরকারি বা বিরোধী দলের যেকোনো সংসদ সদস্য উত্থাপন করেন।

সাবের হোসেন চৌধুরী যেহেতু মন্ত্রী নন, বরং একজন সাধারণ সংসদ সদস্য এবং তিনি যেহেতু এরকম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথা স্পর্শকাতর বিল আনলেন, সেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা অনেকেই সন্দিহান ছিলাম।

আমরা কয়েকজন রিপোর্টার তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) কক্ষে যাই এবং তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, সরকার তথা সরকারি দল এমনকি স্পিকার নিজেও এই বিলটির পক্ষে। সুতরাং বেসরকারি বিল হিসেবে উত্থাপিত হলেও জনগুরুত্ব বিবেচনায় এটি পাস হয়ে যাবে।

তখন আমরাও বুঝতে পারছিলাম, কিছুটা কৌশলগত কারণেই সাবের হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে এবং যথারীতি বিলটি পাস হয়ে যায়, অর্থাৎ আইনে পরিণত হয়ে যায়।

তার মানে এটা খুব পরিষ্কার যে, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী তথা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হেফাজতে নাগরিকের নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধে সরকারের যে সদিচ্ছা, সেটিরই প্রতিফলন এই আইন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত ১০ বছরে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কি বন্ধ হয়েছে? যদি বন্ধ না হয়, তাহলে এই আইনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হয়েছে? সেই মামলার পরিণতিই বা কী? এরকম একটি কঠোর আইন থাকার পরেও কেন হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না? রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সংস্থাগুলো কি এই আইন পাত্তা দিচ্ছে না, নাকি অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া তথা সুরক্ষার নিশ্চয়তা রয়েছে বলে তারা আইনের তোয়াক্কা করছে না?

তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, নিরাপত্তা হেফাজতে কোনো নাগরিকের নির্যাতন বা মৃত্যু হলেও কতজন ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার মামলা করে কিংবা মামলা করার সাহস পায়?

প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে আসছে গত ৩ অক্টোবর চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার (৬৪) মৃত্যুর ঘটনায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার পর শহীদুল্লা থানায় অসুস্থ বোধ করেন। পরে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু শহীদুল্লার পরিবারের দাবি, থানা হেফাজতে পুলিশের নির্যাতনেই তার মৃত্যু হয়েছে।

শহীদুল্লার স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমার স্বামীকে থানায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি কি বড় সন্ত্রাসী নাকি জঙ্গি? তার জন্য থানার ফটক বন্ধ করতে হবে কেন?’

পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শহীদুল্লার মরদেহ হাসপাতালে রেখে চান্দগাঁও থানা পুলিশ বিনা ময়নাতদন্তে হস্তান্তরের জন্য একটি আবেদন তৈরি করে। ওই আবেদনে পরিবারের পক্ষ থেকে সই নেওয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু পরিবারের সদস্য এবং চট্টগ্রামের দুদক কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তার ময়নাতদন্ত হয়। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করেছে পুলিশ।

থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে নির্মমভাবে পেটানো কিংবা মানসিকভাবে নির্যাতনের ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করে কারো মৃত্যু হলে সেটি স্পষ্টতই হত্যাকাণ্ড, সেটা যদি একজন প্রকৃত অপরাধীর সঙ্গেও হয়। যদিও এই ধরনের হত্যার দায়ে খুব বেশি মামলা হয় না বা বিচার হয় না। চলতি বছরে এ পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর সাতটি ঘটনার কথা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৯। (ডয়েচেভেলে, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু রোধে দেশে যে আইন আছে সেখানে বলা হয়েছে, হেফাজতে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তার অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।

আইনে আরও বলা হয়েছে, কাউকে হেফাজতে নির্যাতনের ফলে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে নির্যাতনকারী অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তার অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ দেবেন।

অন্যান্য আইনে যেমন ভুক্তভোগী নিজে অথবা তার পরিবারকে মামলা করতে হয়, এই আইনে সেই বিধানও শিথিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক আদালতে এই অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন যে অমুককে হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে।

আইনের ৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্যাতন করিয়াছে বা করিতেছে এইরূপ কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতকে অবহিত করিলে আদালত ধারা ৫ মোতাবেক অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়া উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করিবেন। (২) যদি অভিযোগকারীর বক্তব্যে আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করা প্রয়োজন তাহা হইলে আদালত উক্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিতে পারিবেন।’

এই আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি অপরাধ করেননি। ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করিতে হইবে যে, তাহার বা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ওই ক্ষতি হয় নাই।’

তবে এটা ঠিক যে এরকম একটি জনবান্ধন আইন থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কারণ, একবার কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হলে, পরবর্তী হয়রানির ভয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। রাষ্ট্র তাকে সেই সুরক্ষাও দিতে পারে না।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোনো বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করার পরে সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে যে আরও কত ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে ধারণা করাও অসম্ভব। বিচার তো দূরে থাক, উল্টো নিত্য নতুন মামলা অথবা ভয়-ভীতির মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়। ফলে খুব সাহসী এবং প্রভাবশালী না হলে কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘাটাতে চায় না। বরং অধিকাংশেরই ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হয়।

শুধু তাই নয়, পুলিশ এই ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাতিলে বিভিন্ন সময়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে। যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জনগণের প্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা আর বিচার-বিশ্লেষণের পরে মানবাধিকারের সুরক্ষায় একটি আইন পাস করলেন, পুলিশের মতো একটি বাহিনীর কী করে সেই আইন বাতিল চায়, বা কী করে তাদের এই দাবি তোলার সাহস হয়—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

কেন নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু রোধ হয় না, তার পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন: সরকার একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুরোধে আইন করলেও এও ঠিক যে, এই আইনকে তারা প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করে। যখন কোনো একটি আইনকে সরকার তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে, তখন ওই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আইনটির অপব্যবহার করে, তখন সেখানে বাধা দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। সরকার যখন কোনো আইনকে তার প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য ব্যবহার করে, তখন সেই আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকা সরকারি বাহিনীর লোকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে, যেমন প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে কাউকে নির্যাতন এমনকি হত্যা করলেও সেখানে সরকারের তরফে খুব শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাই শুধু নয়, যেকোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন—যদি না নিরপেক্ষ তদন্ত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত বা উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করেন তাদের সহকর্মীরাই। যে কারণে বড় ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বা অন্য কোনো বাহিনী বা সংস্থার মাধ্যমের তদন্তের দাবি জানানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজও মনে করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য। (প্রথম আলো, ০৬ জানুয়ারি ২০২১)

বাস্তবতা হলো, একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তো বটেই, সত্যিকারের অপরাধীর সঙ্গেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানবিক আচরণ করতে বলা হয়। কেননা সত্যিই কে অপরাধী আর কে নিরপরাধ, সেটি আদালতে প্রমাণের বিষয়। আবার আদালতে কারো অপরাধ প্রমাণিত হলেও তার সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করা যায় না যেটি অমানবিক বা আইনের খেলাপ। কেননা প্রতিটি অপরাধের শাস্তি আইনে বলা আছে। আদালত সেই আলোকে রায় দেন। যে কারণে ‘আইনের শাসন’ কথাটি এসেছে। কিন্তু আইন-আদালত তথা বিচার বিভাগের তোয়াক্কা না করে যখন কথিত ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে কোনো নাগরিককে মেরে ফেলা হয়; যখন কোনো নাগরিককে হত্যার পরে তার লাশটিও গুম করে দেওয়া হয়—তখন আর সেটি ‘আইনের শাসন’ থাকে না, সেটি হয়ে যায় ‘আইনপ্রয়োগকারীর শাসন’—যা বেআইনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor