Bangladesh

কোথায় গেল সেই ৫৫ কেজি স্বর্ণ

♦ দেড় মাসেও রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি ♦ ডকেট পায়নি পিবিআই থেমে আছে মামলার তদন্ত

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লকার থেকে সাড়ে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনার তদন্ত থমকে গেছে। দেড় মাস আগে স্বর্ণ গায়েবের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও এর পেছনে কারা জড়িত, তার কূলকিনারা এখনো করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থাগুলো। থানা ও ডিবি ঘুরে মামলার তদন্ত ১৫ দিন আগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর দেওয়া হলেও তদন্ত শুরু হয়নি। পিবিআই বলছে, তারা এখনো মামলার ডকেট বুঝে পায়নি। যে কারণে মামলার তদন্তও শুরু করতে পারছে না তারা।

এ অবস্থায় চাঞ্চল্যকর স্বর্ণ গায়েব ঘটনার রহস্য যেমন এখনো অনুদ্ঘাটিত রয়েছে, তেমন ১৫ দিনেও কেন মামলার ডকেট পিবিআইকে দেওয়া হলো না, এ নিয়ে নতুন রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্বর্ণ গায়েব হওয়ার পেছনে কারা জড়িত, জব্দ করা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা না দিয়ে শুল্ক বিভাগের গুদামে কেন রাখা হয়েছিল- এমন প্রশ্নের জবাব এখনো অধরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, শুল্ক বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা এতে জড়িত। তাদের আড়াল করতেই তদন্তে এত ধীরগতি। ৪ অক্টোবর মামলার তদন্ত পিবিআইয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয় পিবিআইকে। পিবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইম (দক্ষিণ)-এর অতিরিক্ত এসপি সারোয়ার জাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারা চিঠি হাতে পেয়েছেন। কিন্তু ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও মামলার ডকেট এখনো হাতে পাননি। এ ব্যাপারে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ডকেট পাবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। ইতঃপূর্বে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উত্তরা বিভাগ এ পর্যন্ত আটজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে দুজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এবং একজন শুল্ক বিভাগের সেপাই এ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে তাদের সন্দেহ। এরা প্রত্যেকেই কারান্তরিন রয়েছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, স্বর্ণ চুরির বিষয়টি শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগস্টেই টের পেয়েছিলেন। শুরুতে তারা সাম্প্রতিক কয়েকটি চালানের মাধ্যমে জমা হওয়া স্বর্ণের বারের হদিস পাচ্ছিলেন না। এরপর তারা গুদামে সংরক্ষিত মালামাল কাগজপত্রের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার উদ্যোগ নেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর হঠাৎ একটি লকার ভাঙা বলে তারা পুলিশে খবর দেন। দাবি করা হয় স্বর্ণ চুরি হয়ে গেছে। যদিও স্বর্ণ চুরির ঘটনাটিকে ‘নাটক’ বলে মনে করেন সে সময়ের তদন্ত কর্মকর্তারা। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২ সেপ্টেম্বর কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা পুলিশকে জানিয়েছেন, বিমানবন্দর লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডস-সংলগ্ন ট্রানজিট গোডাউন টিজিআর-১-এর গুদামের ভিতরে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পান, মূল্যবান পণ্য সংগ্রহের জন্য গুদামে রাখা একটি স্টিলের আলমারির দরজার লক ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এর আগের রাতে প্রতিদিনের মতো আটক করা পণ্য টিজিআর-১-এ জমা করে কাজ শেষে আনুমানিক রাত ১২টা ১৫ মিনিটে গোডাউন তালাবদ্ধ করে চাবি নিয়ে চারজন কর্মকর্তা একসঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস এলাকা ত্যাগ করেন। পুলিশ বলছে, তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ভিতরে একটি স্টিলের আলমারির লক ভাঙা এবং গোডাউনের পূর্বপাশের ওপরের দিকে এসির বাতাস বের হওয়ার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে অনুসন্ধানে চুরির বিষয়টি সামনে আসে। ২ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে যে কোনো সময় ‘কে বা কারা সোনার বার ও স্বর্ণালংকার গোডাউন থেকে স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি করে নিয়ে যায়’ বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ভাঙা আলমারির পাশে ধাতব বস্তু কাটার যন্ত্র পাওয়া গেছে। গুদামের এসির পাশে ভেন্টের অংশটি এ যন্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বাইরে থেকে চোর গুদামে ঢুকেছে, এমনটা দেখাতে জায়গাটি পরিকল্পিতভাবে কাটা হতে পারে বলে পুলিশ ধারণা করছে। তারা বলছে, বাস্তবে ওইটুকু কাটা অংশ দিয়ে কোনো মানুষের পক্ষে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরের ভিতরের প্রতিটি কোনা যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি করা হয়, সেখানে শুল্ক বিভাগের গুদামে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকার বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে দেখছে পুলিশ। তাদের ধারণা, জব্দ স্বর্ণ জমা দেওয়ার সময় দায়িত্বরতরাই অনেকদিন ধরে স্বর্ণের বার এবং অলংকারগুলো একটু একটু করে সরিয়েছেন। এ ছাড়া তদন্ত পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশ গুদামের যে পরিবেশ দেখেছে, সেখানে এই মূল্যবান বস্তুটি সংরক্ষিত রাখার যথার্থতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিমানবন্দরে জব্দ হওয়া ২০০ কেজির বেশি স্বর্ণ গুদামে সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্য থেকে ৫৫ কেজির বেশি চুরির ঘটনা ঘটেছে। বিমানবন্দরে চোরাচালান বন্ধে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), এপিবিএনসহ ২৪টি সরকারি সংস্থা কাজ করে। যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের জন্য মেটাল ডিটেক্টর, হ্যান্ড-হেল্ড মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে, বডি স্ক্যানার মেশিন রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকেও একই কায়দায় প্রায় ২০ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা ঘটেছিল। পরে অডিটের আগ মুহূর্তে চুরির কথা বলা হয়েছিল। ওই ঘটনাটি ঘটেছিল সরকারি ও সাপ্তাহিক ছূটির সময়। এবারও তেমনটাই হয়েছে। পুলিশ এ বিষয়টিও তদন্তের আওতায় নিয়েছে।

জানা গেছে, বিমানবন্দরে সাধারণত তিন ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ উদ্ধার হয়। প্রথমত, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে বৈধ পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত স্বর্ণ জব্দ করা হয়। দ্বিতীয়ত, শুল্কের জন্য সাময়িকভাবে আটক করা স্বর্ণ যার শুল্ক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৃতীয়ত, চোরাচালানের মাধ্যমে এবং বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া স্বর্ণ। এ তিন ক্যাটাগরিতে জব্দ স্বর্ণ বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নিচতলার শুল্ক বিভাগের গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। স্বর্ণ জব্দ হওয়ার পর এর তালিকা তৈরি করে সেগুলো শুল্ক বিভাগের গুদামে রাখার নির্দেশনা আছে। তালিকার একটি কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঠাতে হয়। কাস্টমস কমিশনারের দায়িত্ব প্রতি মাসে গুদামে সংরক্ষিত স্বর্ণ তালিকা অনুযায়ী ঠিক আছে কি না তদারক করা। সেই তদারেকর একটি প্রতিবেদনও এনবিআরের কাছে পাঠাতে হয়। অনেক সময় দীর্ঘদিন ভল্টে স্বর্ণ ফেলে রাখা হলে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। তাই স্বর্ণ জব্দ হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেসব স্বর্ণ জব্দের ঘটনায় মামলা হয়, সে ক্ষেত্রে আদালতে বিচারকাজ শেষে এ স্বর্ণ কোথায় থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাধারণত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আটক স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা থাকে। কিন্তু এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে- এত পরিমাণ স্বর্ণ কেন জমে ছিল? মামলার তদন্ত তদারকিতে যুক্ত রয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, সবশেষ এ স্বর্ণ লোপাটের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা জানতে পারেন স্বর্ণের নিরাপত্তায় যেসব নিয়ম রয়েছে তার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখিয়ে ২০২০ সাল থেকে জব্দ স্বর্ণ শুল্ক বিভাগের গুদামে রেখে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের ভল্টে জমা দেওয়ার জন্য স্বর্ণের তালিকাও তৈরি করা হয়নি। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, গায়েব হওয়া সাড়ে ৫৫ কেজি স্বর্ণের মধ্যে কিছু স্বর্ণ উদ্ধার করেছে কাস্টমস। অথচ এ স্বর্ণগুলোও এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি। যে কারণে মামলার ডকেট পিবিআইকে হস্তান্তর করা যায়নি। মামলার তদন্তও আছে থমকে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d