Bangladesh

খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিস্ময় বাংলাদেশ

খাদ্য উৎপাদনে নীরব বিপ্লব বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছে। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অতীতের খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক সংকটেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। এ যেন খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই বাংলাদেশ এখন ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের ১৪৪ দেশে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। এখন সেই ঝুড়ি ভরে উপচে পড়ছে খাদ্যশস্য। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহরণ।

স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৫০ বছরে এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে চার গুণ বেশি; ভুট্টাসহ এর পরিমাণ প্রায় পাঁচ কোটি টন। দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ৪ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।

কৃষিবিদ আব্দুস সাত্তার বলেন, কৃষি প্রধান দেশে বছরে মানুষের মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি করোনা, টানা দুই বছর খরা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এফএও। বাংলাদেশের খাদ্যের কোনো সংকট হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩। নিরাপদ খাদ্যশস্য রপ্তানিতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এবার খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে দেশে আমন উৎপাদন হয় দেড় কোটি টন, আউশ হয় ৭০ হাজার টন, বোরো থেকে উৎপাদন হয় দুই কোটি ১৫ লাখ টন, গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের বেশি। এছাড়া বছরে ভুট্টা উৎপাদন হয় ৫০ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যা, খরা ও জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।

অপুষ্টি আর খর্বাকৃতির শিশু জন্ম হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উন্নতি অব্যাহত থাকায় ক্ষুধা মুক্তির লড়াইয়ে আরও এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) ১২৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮১তম অবস্থানে উঠেছে। ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। ভারতের অবস্থান ১১১তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১০২তম। প্রতিবছর কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে যৌথভাবে এ সূচক তৈরি করে। চলতি সপ্তাহে এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮৪তম ও ভারত ১০৭তম অবস্থানে ছিল। ২০১৫ সালের পর যে ৭টি দেশ সূচকের স্কোর ৫ পয়েন্ট বা বেশি কমাতে পেরেছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে।

আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকেরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারি করোনাকালে ধান উৎপাদনে একধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বে তৃতীয় বাংলাদেশ। এ ছাড়াও পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ। সবজিতে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। এ ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১০ লাখ টন। বিশ্বে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টন কাঁঠাল হয় ভারতে। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশেই গবাদি পশুর লালনপালন বাড়তে থাকে। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় বিশ্বে কৃষিতে ১১ খাতে এগিয়ে বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দু’টি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দু’টি ফসল হচ্ছে। পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগ ও রপ্তানি বেড়েছে। একসময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে।

আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। বর্তমানে দেশে দেড় কোটি টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) বাংলাদেশের কৃষিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা, চালসহ কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দুই দফায় এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button