Bangladesh

গাজীপুরে সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত: আমার স্ত্রী তো আন্দোলনে যায়নি গুলি মারলো কেন?

গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি সাড়ে ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এক নারী শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। দফায় দফায় সংঘর্ষে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শ্রমিক বিক্ষোভ চলাকালে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা জানান, গতকাল সকালে শ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০)কে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথেই তিনি মারা যান। নিহত পোশাক শ্রমিক সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চর নাটিপাড়া এলাকার জামাল হোসেনের স্ত্রী। তিনি কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। আঞ্জুয়ারার মৃত্যুর তথ্যটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিশ্চিত করা হয়। হাসপাতালে স্ত্রীর লাশের পাশে থাকা জামাল বাদশা বিলাপ করে বলছিলেন, আমার স্ত্রী তো আন্দোলনে যায়নি। তাকে গুলি করে মারলো কেন? কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, আঞ্জুয়ারা সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজে ছিলেন।

পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষের খবর পেয়ে কর্মস্থল থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। পথে পুলিশের গুলিতে আহত হন। হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। 

‘আমার স্ত্রী তো আন্দোলনে যায়নি, গুলি মারলো কেন’: আঞ্জুয়ারা খাতুন। নয় বছর আগে জামাল বাদশার সঙ্গে ঘর বাঁধেন তিনি। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসার ছিল তার। অভাবের সংসারে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন কাজের খোঁজে। সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুরে এসে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। মাত্র দেড় মাস আগে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। গাজীপুরের কোনাবাড়ী ইসলাম গার্মেন্টস-২ নামে একটি পোশাক কারখানায় সেলাই মেশিন অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামীও একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। মঙ্গলবারের মজুরি বোর্ড ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গতকাল গাজীপুরে বিক্ষোভে নামেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। এ সময় কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হন আঞ্জুয়ারা। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত আঞ্জুয়ারা খাতুনের স্বামী জামাল বাদশা বলেন, আমার স্ত্রী তো একজন সাধারণ গার্মেন্টসকর্মী ছিল। সে তো আন্দোলনে যায়নি। তার তো কোনো দোষ ছিল না। তাকে কেন পুলিশ গুলি করে মারলো? আমার স্ত্রীর রক্তের বিনিময়ে হলেও যেন পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য এই আন্দোলন সফল হয়। এই রকম যেন আর কারও মৃত্যু না হয়। কখনো ভাবিনি যে পুলিশের ছোড়া গুলিতে তার এভাবে মৃত্যু হবে। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সে বাসা থেকে বের হয়ে গার্মেন্টসে যায়। এরপর আটটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। আমার স্ত্রী’র চার ভাই-বোন। তার বাবা মন্টু মিয়া কৃষিকাজ করতেন। পাঁচ বছর আগে তিনি মারা যান। নয় বছর আমরা সংসার করি। দশ হাজার টাকার মতো বেতন পেতো আঞ্জুয়ারা। অভাবের সংসারে কোনোমতে দু’জনের ইনকামে সন্তানদের নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতাম। দেড় মাস আগে এই কারখানায় আমার স্ত্রী চাকরি নেয়। আমার ৭ বছরের ছেলে আরিফ ও ৬ বছরের মেয়ে জয়া এতিম হয়ে গেল। আমার সন্তানদের মা হারিয়ে গেছে এটাই আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি। কার কাছে চাইবো এই হত্যার বিচার। কে করবে বিচার? 

তিনি বলেন, এখন আমার সন্তানরা কাকে মা বলে ডাকবে। আমার সন্তানদের কে দেখবে, কে কোলে তুলে নিবে। ওরা শিশু বয়সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের মা’কে হারিয়ে ফেললো। আমার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা ইসলাম গার্মেন্টসে চাকরি করতো। আমি আলাদা একটি গার্মেন্টসে চাকরি করি। সরকার বেতন বাড়ালেও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ হয়। আজ সকালে আবারও বেতন বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। এর মধ্যে গার্মেন্টস ছুটি ঘোষণা করে। আঞ্জুয়ারা গার্মেন্টস থেকে বের হয়ে চৌরাস্তার জারুন এলাকায় এলে পুলিশ গুলি করে।

জামাল বাদশা বলেন, আমার স্ত্রী বাসায় আসার কোনো গলি খুঁজে না পাওয়ায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পরে পুলিশের গুলি তার মাথায় এসে লাগে। ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল সে। সেখান থেকে আঞ্জুয়ারাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

এপিসি কারে বিস্ফোরণ, ৫ পুলিশ আহত: ওদিকে শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে গিয়ে গাজীপুরে এপিসি কারে বিস্ফোরণে ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনের হাতের কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। 

জানা গেছে, গতকাল বিকালে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন নগরের নাওজোড় এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের এপিসি কারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে একজনের হাতের কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আহত সব পুলিশ সদস্যদের প্রথমে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে তাদের তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেয়া হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এপিসি কারের ভেতরে পুলিশ সদস্যদের অসাবধানতায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা আহত হন। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম জানান, আহতাবস্থায় পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য প্রবীর (৩০), ফুয়াদ (২৮) ও খোরশেদকে (৩০) উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আশিকুল (২৭) ও বিপুলকে (২৪) হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে ফুয়াদের অবস্থা বেশি গুরুতর, তিনি ডান হাতের আঙ্গুল ও কব্জির নিচের অংশে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button