Bangladesh

চাঁদাবাজির অনুমোদন চেয়ে চিঠি!

সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করছে, তখন সার্ভিস চার্জের নামে চাঁদাবাজির আবদার জানিয়েছে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সার্ভিস চার্জের নামে কৌশলে চাঁদাবাজির এমন আবদার জানিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।

সংগঠনটি সার্ভিস চার্জ সংগ্রহের জন্য দেশের ৬৪ জেলার ৭৩টি স্থান নির্ধারণ করে একটি তালিকা চিঠির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে তালিকাসহ চিঠিটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এমন চিঠি দেখে পুলিশ কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। কারণ বছর তিনেক আগে পরিবহন নেতারাই ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক বা মহাসড়কে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি করা যাবে না। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী গত শনিবার বলেন, ‘শ্রমিকদের কল্যাণেই আমরা সার্ভিস চার্জ তোলার বিষয়ে আবেদন করেছি। এটিকে চাঁদাবাজি বলা যাবে না। আমরা পুলিশ বা অন্য কারোর কাছ থেকে চাঁদা নেব না। পরিবহন মালিক বা শ্রমিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ ওঠানো হবে।’

তিনি বলেন, এই অর্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা, বিয়েসহ নানা উন্নয়নকাজে তারা ব্যয় করবেন। কোনো দুর্ঘটনা বা ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে তারা অর্থসহায়তা দিতে পারেন না। সার্ভিস চার্জ তুলতে পারলে কিছুটা হলেও এই সহায়তার ব্যবস্থা করা যাবে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘সার্ভিস চার্জ আদায়ের নামে কোনো ধরনের চাঁদা আদায় করার বৈধতা দেওয়া হবে না।’

৭৩টি স্থান নির্ধারণ : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার পূর্ব-দক্ষিণ পাশে, মেরাদিয়া ত্রিমোহনী, কাঞ্চন সড়ক, কামারপাড়া বিশ^ ইজতেমা রোডের মুন্নু গেট, গাজীপুরের কড্ডা ট্রাক টার্মিনাল, কোনাবাড়ী নতুন বাজার রোড, গাজীপুর চৌরাস্তা, নগ্নপাড়া ট্রাক টার্মিনাল, নরসিংদী সাহেপ্রতাব মোড় অফিস, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ম-লপাড়া ব্রিজের ঢাল, জামালপুর শহরের বাইপাস সড়ক, মানিকগঞ্জের আরিচা-পাটুরিয়া ঘাট, টাঈাইলের মধুপুর বাসস্ট্যান্ড, নেত্রকোনার পূর্বধলা লালমিয়া বাজার, দুর্গাপুরের কৃষ্ণারচর, টাঈাইলের এলেঙ্গা বাজার, বাগেরহাটের মোংলা মহাসড়ক সংলগ্ন বি-ইলেকট্রনিক ফ্যাক্টরি এলাকা, খুলনা মেট্রোপলিটন হরিণটানা জিরো পয়েন্ট, যশোর রোড়ের শেষ সীমানা, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের প্রবেশমুখ সংলগ্ন কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনাল, সাতক্ষীরার লাবনা বাইপাস সড়কসংলগ্ন জিরো পয়েন্ট, যশোরের নওয়াপাড়া ট্রাক টার্মিনাল, ঝিকরগাছা বাজার, খুলনার মেঘনা ও পদ্মা ডিপোর সামনে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা রোডে প্রস্তাবিত ট্রাক টার্মিনালের ঘোড়ামারা ব্রিজের সামনে, মেহেরপুর বাস টার্মিনালসংলগ্ন ওয়াপদা মোড়, মাগুরা পারনান্দুয়াখালী ৩ নম্বর ব্রিজের সামনে, মাগুরা বাস টার্মিনালের উত্তর পাশে ৩ নম্বর ব্রিজ পারনাম দোয়ালী, নড়াইল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে, কুষ্টিয়ার মিরপুরের গোবিন্দপুর তালবাড়িয়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে, ঝিনাহদহের চুটলিয়া, যশোরের বেনাপোল বাইপাস সড়ক, সাতক্ষীরার কলারোয়ার ইউরেকা ফিলিং স্টেশনের সামনে, কালিগঞ্জের প্রবেশ মুখে ট্রাক টার্মিনালের সামনে, বেনাপোলের বাগআচড়া শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসের সামনে, যশোর-খুলনা রোড়ের রাজারহাট, বরিশালের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত দপদপিয়া সেতুর টোল সংলগ্ন স্থান, ঝালকাঠি পুলিশ লাইনস রোড, ভোলার পরানগঞ্জ গোলচত্বর, ইলিশা, পটুয়াখালীর টাউন কালিকাপুর ব্রিজের টোলসংলগ্ন বড় চৌরাস্তা, বরগুনার ঘটখালী বাজার, পিরোজপুরের বাইপাস সড়ক পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, মাদারীপুরের মস্তফাপুর জিরো পয়েন্ট, শরীয়তপুরের মনোহারবাজার মোড়, ফরিদপুরের ভুমরাকান্দির সানি পাম্প, রাজবাড়ী সদরের কল্যাণপুর, গোপালগঞ্জের বেতগ্রাম নতুন বাস টার্মিনাল, পঞ্চগড় সুপার মিলের সামনে, ঠাকুরগাঁওয়ের বিজিবি ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশে, দিনাজপুরের পুলহাট সদর ও বালুবাড়ি মোড়, সৈয়দপুরের ইউনিক অটোর সামনে, রংপুরের পীরগঞ্জ বড় দরগা, কুড়িগ্রাম সদরের জয়বাংলা মোড়, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর কোমরপুর বাজার ও শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয় সংলগ্ন বগুড়া-রংপুর রোড, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ফাসিরতলা, সিলেট-ঢাকা বাইপাস রোডের শেরপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুরের জগদীশপুর, মৌলভীবাজারের শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বর, সুনামগঞ্জের গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়ার বাঘোপাড়া এরুলিয়া বাজার, জয়পুরহাটের পাকুরতলা বাইপাস, নওগাঁর এনায়েতপুর-গাবতলী বাইপাস, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দ্বারিয়াপুর আলহাজ ফজলুল করিম শেলী ট্রাক টার্মিনালের সামনে, রাজশাহীর নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনাল, নাটোরের বেলঘরিয়া বাইপাস, বগুড়া-নাটোরের সিংড়া বাস টার্মিনাল, পাবনার  ঈশ্বরদীর দাশোরিয়ার মোড়, সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার হাটিকমরুল মোড় ধোপাাকান্দি, বগুড়ার কৃষ্ণপুর বাইপাস রোড়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া স্টেশন রোড।

পুলিশের পদক্ষেপ : পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এমন আবদার পূরণ করার পরিবর্তে কঠোরভাবে দমন করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। যারা যানবাহন বা অন্য কোনো স্থানে চাঁদাবাজি করছে বা চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের তালিকাও তৈরি করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত ট্রাস্কফোর্সকে নিয়মিত তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, গত বছরের ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মহাসড়কে কোনো ধরনের অবৈধ যানবাহন চলতে পারবে না। যানবাহন আটকে চাঁদা আদায় করা যাবে না। শ্রমিক নেতাদের নামে যানবাহন থেকে অর্থ তোলা যাবে না।

পুলিশ বলছে, অবৈধ যানবাহনের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলছে এসব যানবাহন। এই অবৈধ যানবাহন থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা তোলা হয়। পুুলিশ সদর দপ্তরও বিভিন্ন মহাসড়কে গোপন জরিপ চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে চাঁদাবাজি হচ্ছে মহাসড়কে। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। পুলিশের অসাধু সদস্য ও নেতাদের পকেটে যাচ্ছে চাঁদার ভাগ।

অবৈধ যানবাহনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মহাসড়কে কোনো অবৈধ যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ কেউ না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) শাহাবুদ্দিন খান বলেন, মহাসড়কে সব ধরনের অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশের কোনো সদস্য যানবাহনের চালকদের কাছ থেকে কোনো ধরনের চাঁদা আদায় করার প্রমাণ মিললে আইনের আওতায় আনা হবে।

সার্ভিস চার্জের প্রস্তাব বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সংগঠনের অনৈতিক আবদার রাখা হবে না। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি।’ 

সরেজমিন চিত্র : সম্প্রতি আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি আহসান হাবিব অপু রাজশাহী শহরের বাস, ট্রাক টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেছেন রাস্তার পাশে টেবিল পেতে বসে, লাঠি দেখিয়ে আদায় করা হয় চাঁদার টাকা। নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় ট্রাক টার্মিনালের সামনে ট্রাক মালিক সমিতি ও শ্রমিকদের নিয়োজিত কয়েকজন লাঠি হাতে সিøপ দিয়ে টাকা নেন। ট্রাকচালকরা গতি কমিয়ে ১০০ টাকা দিয়ে চলে যান। রাজশাহী সিটি হাটে ট্রাক লোড হওয়ার সময় ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। সেখানেও শ্রমিক ও  ট্রাক মালিক গ্রুপের পক্ষ থেকে টাকা আদায় করা হয়। রাজশাহী থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস নগরীর বাস ট্রার্মিনাল, রেলগেট, ভদ্রা, কাশিয়াডাঙ্গা পার হওয়ার সময় টার্মিনাল ও বাস মাস্টারদের মাধ্যমে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের নামে টাকা আদায় করা হলেও এ নিয়ে শ্রমিকদেরই নানান প্রশ্ন রয়েছে। টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ রয়েছে নেতাদের বিরুদ্ধে।

গাজীপুর প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম জানান, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী মুন্নু গেট, কোনাবাড়ী নতুন বাজার এবং কড্ডা এলাকায় বাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান স্ট্যান্ডে আদায় হচ্ছে চাঁদা।

তাকওয়া পরিবহনের বাসচালক সেলিম হোসেন জানান, প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা দিতে, যাকে তারা জিবি বলেন। পরিবহনশ্রমিক নেতারা এই টাকা নেন। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে চন্দ্রা, মাওনা, জৈনা বাজার, জয়দেবপুর শহরসহ বিভিন্ন সড়কে তাকওয়া পরিবহনের প্রায় ৩০০ বাস ও লেগুনা চলাচল করে থাকে। কড্ডা এলাকায় প্রতিদিন ট্রাক থেকে ৫০-১০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।

গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান আহামদ সরকার বলেন, ‘অবৈধ বা অন্যায়ভাবে কোনো পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা হয় না। আমরা সরকার নির্ধারিত হারে শ্রমিকদের জন্য টাকা তুলে থাকি। সেই টাকা শ্রমিকদের প্রয়োজনে তাদের সেবায় ব্যয় করা হয়।’

পরিবহন নেতা আক্কাস আলী বলেন, গাজীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় সাতটি পরিবহন কোম্পানির প্রায় এক হাজার যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে থাকে। এসব বাস সার্ভিস থেকে দৈনিক ৩০-৫০ টাকা করে শ্রমিক ইউনিয়নকে দেন তারা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button