চিকিৎসায় পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে এখনো প্রতিদিন পাঁচ বছরের নিচে ৭৪ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। বছরে মৃত্যু হচ্ছে ২৬ হাজার ৭৬৬ শিশুর। এই মৃত্যু পাঁচ বছরের নিচের বয়সী মোট শিশু মৃত্যুর ২৪ শতাংশ। এমনকি বাংলাদেশে যে আট কারণে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, এর মধ্যে মূল কারণ নিউমোনিয়া।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটোলজি ও পেডিয়াট্রিকস বিভাগের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এরপর ২২ শতাংশ শিশু মারা যাচ্ছে অপরিণত ও কম ওজনের কারণে, ১৮ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে জন্মের সময় অক্সিজেন ঘাটতির কারণে, ১৬ শতাংশ অন্যান্য কারণে, ৭ শতাংশ জন্মগত ত্রুটির কারণে, ৬ শতাংশ পানিতে ডুবে, ৪ শতাংশ জটিল সংক্রমণ ও ৩ শতাংশ ডায়রিয়ায়।
বিএসএমএমইউর নিউনেটোলজি বা নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে বলেন, ‘নিউমোনিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলো মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। কখন রোগীকে হাসপাতালে আনতে হবে, সেটা অন্ততপক্ষে মানুষ জানতে পেরেছে। হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারেরও রেফারেল সিস্টেম শক্তিশালী হয়েছে। চিকিৎসা প্রটোকল হয়েছে। নিউমোনিয়ার টিকাও দিচ্ছে সরকার। সে ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া ও নিউমোনিয়া-সম্পর্কিত মৃত্যু অনেক কমে এসেছে। এ জন্য পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু অনেক কমে এসেছে।
উপজেলা পর্যায়ে নিউমোনিয়ার রোগী রেফারেল সিস্টেমটা এখন খুব ভালো বলেও জানানা এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘আগে যেমন অক্সিজেন বেশি ও কম ব্যবহার করা হতো, এখন সরকার অক্সিজেন থেরাপি কী হবে, কাকে কতটুকু অক্সিজেন দেবে, চিকিৎসা কীভাবে দেবে, এর গাইডলাইন করে দিয়েছে। এখন সেটার ট্রেনিং চলছে।
এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের শিশু পালমোনোলজি ডিভিশনের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিমা ভদ্র বলেন, নিউমোনিয়ার প্রতিরোধে মূল সংকট দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। এ জায়গায় কমিউনিটি লেভেলে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এর কারণ নির্ণয় করে যদি অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকমতো দেওয়া যায়, তাহলে এই সংকট কাটবে। শহরে নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার গ্রামের থেকে বেশি। গ্রামের মায়েরা কম খাওয়ান। গ্রামেরা মায়ের ১-২ মাস পরেই সম্পূরক খাবারে চলে যান। অন্যান্য খাবার খাওয়ান। অথচ বুকের দুধ নিশ্চিত করা গেলে শিশুর নিউমোনিয়া ঝুঁকি অনেক কমে যায়। এ ছাড়া যদি টিকার তিনটি ডোজই দেওয়া যায়, তাহলেও নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে। আরেকটা হলো ঘরের ভেতর ধোঁয়া, চুলার পাশে থাকা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা, একটা ঘরে অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকা এগুলো যদি কমানো যায়, বাবা-মা যদি ঘরের ভেতর ধূমপান না করেন, তাহলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে। একটা ছোট বাচ্চা ধরার আগে ভালো করে হাত ধোয়া, সর্দি-কাশির সময় নাক-মুখ আড়াল করা এসব করলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে।
বেশি মৃত্যু জন্মের ১-১১ মাসের মধ্যে : সার্ভে ও গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ২০ জন নবজাতক মারা যাচ্ছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এই মৃত্যু ১২ জনে নামিয়ে আনতে হবে। এই মৃত্যুর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউমোনিয়ায়, যা মোট শিশুমৃত্যুর ২৬ শতাংশ। শীর্ষে রয়েছে অপরিণত ও কম ওজনের কারণে, ৩২ ও ২৭ শতাংশ নবজাতক মারা যাচ্ছে জন্মের সময় অক্সিজেন ঘাটতির কারণে। অন্যান্য কারণে মারা যাচ্ছে ১৫ শতাংশ।
জন্মের ১-১১ মাসের মধ্যে প্রতি হাজারে মারা যাচ্ছে ৫ জন। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ শিশু মারা যাচ্ছে নিউমোনিয়ায়। অন্যান্য কারণে মারা যাচ্ছে ৪৪ শতাংশ। ১১ শতাংশ ডায়রিয়ায় ও জটিল সংক্রমণে ৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
জন্মের ১২-৫৯ মাসের মধ্যে মারা যাচ্ছে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে ৬ জন। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে ১২ শতাংশ, পানিতে ডুবে ৪৬ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৩৭ শতাংশ ও জন্মগত ত্রুটির কারণে ৬ শতাংশ।
এখন মারা যাচ্ছে ৭ জনের বেশি : বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ ও বিডিএইচএস-২০২২ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু কমেছে সামান্যই। পাঁচ বছর আগে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে মারা যেত ৮ শিশু, এখন তা কিছুটা কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৪। তবে এই সময়ে অপরিণত ও কম ওজনের কারণে মৃত্যু বেড়ে ৪ দশমিক ৯ থেকে ৬ দশমিক ৯ হয়েছে।
চিকিৎসায় পিছিয়ে বাংলাদেশ : বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রিভেনশন অ্যান্ড নিউনেটাল অব নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়া (জিএপিপিডি) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, নবজাতক শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়ার ২৩ শতাংশ ঝুঁকি কমে যায়। সেই লক্ষ্যমাত্রা ৫০ শতাংশ থেকে পেরিয়ে বাংলাদেশ ৬৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। নিউমোনিয়ার টিকার লক্ষ্যমাত্রা ৯০ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ চার ধরনের টিকার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে সর্বনিম্ন ৯৪ থেকে সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যমাত্রা ৯০ শতাংশ হলেও সেখানে সময়মতো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ এবং অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ক্ষেত্রে মাত্র ৩৪ শতাংশ; অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে রয়েছে।
এ ব্যাপারে ডা. সিমা ভদ্র বলেন, জিএপিপিডি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, নিউমোনিয়ার কারণে শিশুমৃত্যু কমাতে হলে ২০২৫ সালের মধ্যে তিনটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। যেখানে সামগ্রিক অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৮৪, সেখানে বাংলাদেশে অর্জন হয়েছে ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে একটি লক্ষ্যমাত্রা, অর্থাৎ চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে।
এই চিকিৎসক বলেন, নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে তিনজনেরও কম শিশুমৃত্যুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন সেটা ১ হাজার জনে মারা যাচ্ছে ৭ জনের বেশি।
আজ বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস : চিকিৎসকরা জানান, নিউমোনিয়া এখনো বিশ্ব ব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ। এই রোগের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ১৪ শতাংশ। এমন অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।