Hot

তাল মেলে না খাদ্যমূল্যে

এই মুহূর্তে বিশে^র দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। তারপরও সারা বিশে^ খাদ্যপণ্যের দাম তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। যার প্রভাবে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বিশে^ খাদ্য সস্তা হলেও বাংলাদেশের মানুষকে তা কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্যে। কারণ হিসেবে আমদানি পণ্যে ডলারের বাড়তি দামের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণের অভাবেই মানুষকে উচ্চমূল্যে খাদ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে।

রমজানের আগমুহূর্তে বিশে^র বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে এখন মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক ৯ দশমিক ১ শতাংশ, আলজেরিয়া আগের মাসের চেয়ে কমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আজারবাইজানে এক মাসের মাথায় চমক দেখা দিয়েছে অর্থনীতিতে। ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ থাকলেও জানুয়ারিতে তা ১ দশমিক ৭ শতাংশে ঠেকেছে। ব্রুনাইয়ে শূন্য দশমিক ৭, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে ৩ দশমিক ৯৭, জর্ডানে ১ দশমিক ৯৭, কুয়েতে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রয়েছে জানুয়ারিতে। আর বাংলাদেশে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬, যা ডিসেম্বরের তুলনায় কমেনি, বরং বেড়েছে।

বাংলাদেশের মতোই আমদানিকারক দেশ সৌদি আরবে সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য ৩ দশমিক ৪৩ রিয়াল থেকে ৪ দশমিক ১৬ রিয়াল। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ১১০ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা। অথচ বাংলাদেশে এখন সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৫ টাকা। চিনি উৎপাদনে বিশে^ দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত।

খরা মৌসুমের কারণে দেশের বাজারে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪৪ রুপিতে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪৯ থেকে ৫৭ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হওয়া শ্রীলঙ্কায় এক কেজি সাদা চিনির দাম ২৯০ শ্রীলঙ্কান রুপি, যা এক ডলারেরও কম। আর আমদানিনির্ভর চিনি বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকায়, যেটি গত বছর মার্চ মাসেও ছিল ৭২ থেকে ৭৮ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নই দাম বৃদ্ধির এটিই প্রধান কারণ। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের দাম শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশে^র প্রায় সব দেশেই বেড়েছে। তবে বাংলাদেশে ডলারের দাম যতটা না বেড়েছে, তার চেয়ে পণ্যমূল্য অনেক বেশি বেড়েছে সিন্ডিকেটের কারণে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রোজায় দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় চিনি, ভোজ্য তেল, গম, ডাল ও ছোলার। আসন্ন রোজায় দেশে আমদানি করা এসব নিত্যপণ্যের যে চাহিদা রয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই আমদানি করেছে প্রভাবশালী একটি গ্রুপ। এ ছাড়া আরও কয়েকটি গ্রুপের কাছে বাংলাদেশের খাদ্যপণ্য জিম্মি হয়ে পড়েছে।

শুধু আমদানি করা পণ্যই নয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও লাগামহীন। এবারের মৌসুমে মুড়িকাটা পেঁয়াজও ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে কেনা যায়নি। সিন্ডিকেট এখন আমদানি পণ্য ছাড়িয়ে দেশীয় পণ্যেও প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। আলুসহ শীতকালীন সব ধরনের সবজি এবার চড়া দামে কিনেছেন সাধারণ মানুষ।

চলতি মাসের শুরুতে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা-এফএওর বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, খাদ্যশস্য ও মাংসের দাম গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে ঠেকেছে। জানুয়ারিতে বিশ্ব খাদ্য সূচক নেমে ১১৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে, যেটি আগের মাসেও ছিল ১১৯ দশমিক ১ পয়েন্টে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর গত জানুয়ারি মাসে এটি সর্বনিম্ন সূচক।

এফএওর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদন ভোক্তা মূল্য সূচকে (সিপিআই) জানুয়ারির তথ্যে দেখা যায়, দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ফের বেড়েছে। যদিও শীতের মৌসুমে সবজির দাম সবসময়ই কম থাকে। তবে গত জানুয়ারিতে এটি ছিল ব্যতিক্রম।

১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের মজুদ রয়েছে ১৪ লাখ ২৫ হাজার ৩৮৭ টন। অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম। দেশে বার্ষিক চাহিদা ৭০ লাখ টন। বিপরীতে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে গমের মজুদ ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৯০ টন রয়েছে বলে জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এফএও তার মাসিক আপডেটে বলছে, ‘রপ্তানিকারকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে সম্প্রতি শস্য সরবরাহের কারণে জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী গমের রপ্তানি মূল্য কমেছে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংকস গ্লোবাল ইকোনমিকস প্রসপেক্টস ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ ও ’২৫ সালে খাদ্যের দাম আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এতে ঝুঁকিও আছে। সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে জ¦ালানির দাম বৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়া, বাণিজ্য বিধিনিষেধ এবং ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এগুলো প্রভাব বিস্তার না করলে খাদ্যের দাম কমবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, আমদানি সংকোচন নীতি, ডলারের বহুমুখী দামসহ বিভিন্ন কারণে ঘোষণা দিয়েও খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশের খাদ্যের দামের অস্থিরতার আরেকটি বড় কারণ আমদানিনির্ভরতা। বিশেষ করে বিকল্প বাজার না খুঁজে একক দেশের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দেশের বাজারে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা দেয়।

বাংলাদেশে অস্থিরতা থাকলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাইকারি পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে দেশটির সব পণ্যের পাইকারি দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। প্রাথমিক পণ্যের পাইকারি দাম কমেছে ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। উৎপাদিত পণ্যের দাম কমেছে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। শুধু খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।

টি কে গ্রুপের পরিচালক সাইফুল আতহার তাসলিম বলেন, গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে অনেক বেশি। পাশাপাশি আমদানিকৃত প্রতি পণ্যে সরকার নির্ধারিত শুল্ক যুক্ত হয়। হিসাব অনুযায়ী, গত বছর যে পণ্যের মূল্য ১০০ টাকা ছিল, বর্তমানে তা ১৪৫ টাকা হওয়া স্বাভাবিক। এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির ফলে টাকার বিপরীতে ডলারে ৪৫ শতাংশ ও পণ্য আমদানিতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হয়। সব মিলিয়ে বহির্বিশে^ পণ্যের মূল্য কমলে দেশের বাজারে সেভাবে কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে গত সাত মাস ধরে মাংসের মূল্য সূচক অব্যাহতভাবে কমছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারি মাসে এ হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। অথচ সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি মাসে দেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বর্তমানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। যদিও বাংলাদেশকে মাংস আমদানি করতে হয় না।

এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ইফতারের অন্যতম উপরকণ খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে। এমন কর প্রত্যাহারেও খেজুরের বাজারে ভোক্তা সুফল আসেনি। ফলে রমজান শুরুর প্রায় এক মাস আগেই বাজারে বেড়েছে খেজুরের দাম। প্রতি কেজি খেজুরে দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করিম বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বেড়েছে। যার ফলে ডলারে কোনো পণ্য আমদানি করলে তার দাম বেড়ে যায়। এর জন্য শুধু খেজুর নয়, সব ধরনের ফলের দাম বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের ছাড়ের মানসিকতা নেই। এর জন্য সরকার উদ্যোগী হলে আমাদের দেশেও ছাড়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠত।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দেশের মূল নীতিনির্ধারকদের জায়গা ব্যবসায়ীদের হাতে থাকার কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াতে মরিয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পণ্যের দাম কমের দিকে থাকে তখন ব্যবসায়ীরা চুপসে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ব্যস্ত থাকে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button