দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিকদের ধরতে যৌথ টাস্কফোর্স
দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিকদের ধরতে যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের চিন্তা করছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের চারটি সংস্থার সমন্বয়ে শিগগির এ ধরনের টাস্কফোর্স গঠন করা হতে পারে। কিভাবে অভিযানের পরিকল্পনা করা হবে, সেই রূপরেখাও প্রায় চূড়ান্ত বলে জানা গেছে। দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স হচ্ছে। এই টাস্কফোর্সকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা সেল বিএফআইইউ। ১/১১-এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের আমলে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের আদলেই মূল কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় ও জেলাভিত্তিক অভিযানের ছকে যৌথ টাস্কফোর্সের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হতে পারে অক্টোবরে।
তবে বিভিন্ন প্রস্তুতির জন্য অক্টোবর নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু করতে না পারলে অবশ্যই জানুয়ারি মাসের মধ্যে এই কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ রয়েছে।
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে সমাজে একটি আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া এই অভিযানের মূল দায়িত্ব দুদক ও এনবিআরের। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থা জড়িত হলে তাতে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে।
তবে এই টাস্কফোর্স গঠনকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন তাঁরা।
তাঁরা মনে করেন, এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তবে এতে ক্ষমতাবেষ্টিত ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে এবং পদ্ধতিগত সংস্কারে মত দিয়েছেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কার প্রয়োজন। পদ্ধতি সংস্কার না করলে আজক একজন দুর্নীতিবাজ ধরলে কাল আরেকজন দাঁড়াবে।
ফলে দীর্ঘ মেয়াদে কোনো লাভ হবে না।
সূত্র জানায়, সাবেক সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থপাচার, কর ফাঁকি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন—এমন ব্যক্তিদের ধরতে কাজ করবে টাস্কফোর্স।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু হয়েছিল যৌথ অভিযান। এরপর ২০০৭ সালে ১/১১-এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলেও একই ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকে রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নজির আছে। তবে আগের দুইবারের প্রেক্ষাপটের তুলনায় এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও সন্ত্রাসীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালালে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালালে সেখানে জনগণের সমর্থন থাকে। এখন পুলিশ ও সরকারি প্রশাসনের (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) মধ্যে আস্থা ফিরে না আসায় এই কাজে বিলম্ব হচ্ছে। তবে অভিযান পরিচালনায় যত দেরি হবে, তার গ্রহণযোগ্যতা ততটা কমে যাবে। এতে দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের রক্ষার সুযোগ তৈরি হবে।
জানা গেছে, ১/১১-এর আদলে এবারও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর ও জেলাভিত্তিক টাস্কফোর্স গঠন করা হতে পারে। টাস্কফোর্সের মূল দায়িত্বে থাকবেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ চলে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। সেই সঙ্গে তাদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। অভিযানে ব্যক্তিকে ধরা গেলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে।
অভিযানে অর্থপাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ উপার্জন ইস্যুতে যারা গ্রেপ্তার হবে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক। একই সঙ্গে কর ফাঁকি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করবে সিআইসি। এসব বিষয় প্রমাণিত হলে তাকে সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। টাস্কফোর্স গঠনের জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী কর্মকর্তাদের বাছাই করে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব শেষ করতে পারলে শিগগিরই সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা আসতে পারে।
জানা গেছে, এই যৌথ টাস্কফোর্সে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ দেবেন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা। এর আগে বিভিন্ন অভিযানে অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি অদৃশ্য কারণে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেলেও এবার সেই সুযোগ থাকবে না। তাই সব কিছু ঠিকঠাক করে মাঠে নামার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অবশ্যই ইতিবাচক। এমন একটি টাস্কফোর্স গঠন করার জন্য আমাদের প্রস্তাব ছিল। যে উদ্দেশ্যে এই টাস্কফোর্স, আশা করি তা সফল হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দুর্নীতিবাজদের তালিকা বেশ লম্বা। সব কাজ একসঙ্গে করতে পারবে না। তাই ক্ষমতাবেষ্টিত ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে কাজ করা উচিত।’
জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য ও সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আমিনুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এতে সারা দেশে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। নানা বিভাগের লোক কাজ করায় সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়। আর এখানে মূলত কাজটা হচ্ছে দুদক ও সিআইসির। এই দুই সংস্থা একে অন্যের সঙ্গে কাজ করতে পারে। কিন্তু সামরিক বাহিনী, পুলিশ যদি এতে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে এটা সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। অন্য সংস্থাগুলো ঢুকলে আমার আশঙ্কা এটা ব্যর্থ হতে পারে।’ বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে পদে পদে, ঘরে ঘরে ও ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতি একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এসব বৈষম্য থেকেই ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। দুর্নীতি যেভাবে ছেয়ে গেছে, তাতে নানা জায়গা থেকে এর মূল উৎপাটন করতে হবে। যার যার ক্ষেত্র থেকে ও সামগ্রিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। শুধু দুদক বা এনবিআর কাজ করলে হবে না।