USA

নিজের জালে নিজেই কি জড়িয়ে পড়বেন ট্রাম্প?

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ নীতি নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এতে দেশ জুড়ে মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলারের অবমূল্যায়নের আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’র (আমেরিকা ফার্স্ট) কথা বলে প্রচারে ঝড় তোলেন তিনি। যার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁকে ফের এক বার নির্বাচিত করেছে আটলান্টিকের পারের বাসিন্দারা। কিন্তু, কুর্সিতে বসে সেই নীতি কার্যকর করলে বড় বিপদ ডেকে আনবেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটির পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান?

তিনি, নবনির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাঁর ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ নীতির বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা। অর্থনীতিবিদদের একাংশের দাবি, কোনও কিছু না ভেবে জোর করে আমেরিকা ফার্স্ট নীতি প্রয়োগ করলে আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনবেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারের ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ নীতি কার্যকর হলে ডলারের দাম হু হু করে কমবে। দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতি। যা আমেরিকায় ডেকে আনবে আর্থিক মন্দা। এর প্রভাব থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশও বাঁচতে পারবে না বলে স্পষ্ট করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন আমেরিকার কিংবদন্তি বাজার বিশ্লেষক ও লগ্নিকারী জিম রজার্স। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর স্টক মার্কেটের দিকে সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলেছেন তিনি।

শুধু তা-ই নয়, শেয়ার ছেড়ে সোনা বা রুপোর মতো নিরাপদ সম্পদে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন জিম।

উল্লেখ্য, আগামী বছরের (২০২৫ সাল) জানুয়ারিতে শুরু হবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় বারের কার্যকাল।

ডোনাল্ডের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কড়া সমালোচনা করতে গিয়ে জিম বলেছেন, ‘‘এটা কখনওই আমাদের দেশের জন্য ভাল নয়। বিশ্ব অর্থনীতিও এতে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এই নীতি বাণিজ্য যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলবে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে দুনিয়া জু়ড়ে আসবে আর একটা মন্দা।’’

নির্বাচনী প্রচারে আমেরিকাকে ফের এক বার ‘মহান দেশ’-এ পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প। আর জন্য আমদানি সামগ্রীর উপর শুল্ক বৃদ্ধির কথা বলেছেন তিনি। পাশাপাশি, ঘরের মাটিতে যাবতীয় শিল্পসামগ্রী নির্মাণের কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। এক কথায়, আমেরিকাকে উৎপাদন শিল্পকেন্দ্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির এই নেতা।

আর এইখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, প্রেসিডেন্ট হয়ে আমদানি শুল্ক অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিলে অন্যান্য দেশও সেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করবে, যা অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির আগুনে ঘি ঢালার শামিল হবে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে।

সংবাদ সংস্থা ‘দ্য ফিন্যান্সশিয়াল’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রজার্স বলেছেন, ‘‘কোনও সন্দেহ নেই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সর্বাগ্রে আমেরিকা নীতি চিনা অর্থনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করবে। কিন্তু, এটি বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একেবারেই ভাল নয়। বেজিংয়ের আর্থিক লোকসানের আগুনে পুড়বে ওয়াশিংটনও।’’

রজার্সের দাবি, বর্তমানে আর্থিক সঙ্কট কিছুটা সামলে উঠেছে আমেরিকা। ‘‘আর তাই ফেডারেল ব্যাঙ্ক সুদের হার অনেকটা কমিয়েছে। শুল্ক যুদ্ধের জেরে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেলে ফের তা আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারে। যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দা ডেকে আনবে।’’ সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন রজার্স।

আর্থিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য আমেরিকার ঋণের পরিমাণ কমানোর ব্যাপারে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ভারত বা চিনের সঙ্গে বাণিজ্য সীমাবদ্ধ করে সেটা করা উচিত হবে না বলেই মন্তব্য করেছেন তাঁরা। তাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আগামী বছর (২০২৫ সাল) আমেরিকার শেয়ার বাজারে বড় পতন দেখা যাবে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাঁরা। গত দু’বছরে বাজার যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, স্টকের সূচক তার চেয়ে বেশি নামতে পারে বলে মিলেছে সতর্কবার্তা। সেই অবস্থায় আমেরিকা ফার্স্ট নীতির জেরে আর্থিক মন্দা শুরু হলে বাজারের ঊত্থান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেই মত তাঁদের।

ভোট প্রচারে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক পরিমাণে কর্পোরেট কর কমানোর অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প, যা আমেরিকার অর্থনীতির পক্ষে ভাল না-ও হতে পারে। এতে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে ভারতের ফার্মা, গাড়ি নির্মাণ এবং বস্ত্রশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, এই সমস্ত পণ্যের ভারী শুল্কের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এইচ ১-বি ভিসার নিয়ম কঠোর করতে পারেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এই বিষয়টি ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পগুলিকে লোকসানের মুখে ফেলতে পারে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হতেই বিশ্বব্যাপী ডলার শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। কিন্তু তাঁর আমেরিকা ফার্স্ট নীতির জেরে আর্থিক মন্দা এলে সেই জায়গা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে আমেরিকান মুদ্রা। অন্য দিকে, রাশিয়া, ভারত, চিনের মতো ব্রিকস দেশগুলি ডলারকে সরাতে আলাদা একটি মুদ্রা নিয়ে এলে তা ওয়াশিংটনের পক্ষে একেবারেই ভাল হবে না। তা বলাই বাহুল্য।

ট্রাম্পের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির নীতির কেন সমালোচনা করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা? তাঁদের যুক্তি, বিদেশ, বিশেষত চিন থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের কারখানা নিজের দেশে সরিয়ে আনলে অন্য সমস্যা দেখা দেবে। শ্রম আইনের নিরিখে সে ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনে অনেক বেশি খরচ করতে হবে ওয়াশিংটনকে। এত দিন সস্তা দরে যা করে এসেছে বেজিং।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, মুখে আমেরিকা ফার্স্ট নীতির কথা বললেও তা কেবলমাত্র চিনের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে পারেন ট্রাম্প। বেজিংয়ের আর্থিক আধিপত্য ভাঙার নীল নকশা ছকতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। অন্য দেশের পণ্যের উপর শুল্ক চাপিয়ে আর্থিক মন্দা ডেকে আনার মতো বোকামি করবেন না এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button