Science & Tech

পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কারের বিস্ময়কর কাহিনি

এক্স রে আবিষ্কারের পর রন্টজেন সবার আগে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন আরেক ফরসী বিজ্ঞানী, হেনরি পয়েনকেয়ারকে। একদিন এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হচ্ছিল ফ্রান্সে। অনেক দামি-দামী ফরসী বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। সেই সম্মেলনে পয়নকেয়ার রন্টজেনের আবিষ্কারটা দেখান।

সেই সম্মেলনে হাজির ছিলেন হেনরি বেকরেল নামে আরেক তরুণ বিজ্ঞানী। রন্টজেনের আবিষ্কার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পয়নকেয়ারকে জিজ্ঞেস করেন, ক্যাথোড টিউবের ঠিক কোথায় এক্স রশ্মি দেখা যাচ্ছে। পয়েনকার জানালেন ক্যাথোডের বিপরীত দিকে যেখানে উজ্জ্বল প্রতিপ্রভা তৈরি হয়, সেখানেই আসলে এক্স রশ্মি উত্পন্ন হচ্ছে।

বেকরেল ভাবলেন, প্রতিপ্রভা আর এক্সরশ্মির নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। বেকরেল উত্সাহী হয়ে ওঠেন এক্স রশ্মিতে। এর কারণও আছে। পয়েনকেয়ারের সঙ্গে আলোচনার পর হেনরি কাজে লেগে পড়েন। ইউরেনিয়ামের মতো প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী বস্তু এক্সরশ্মি বিকিরণ করে কিনা সেটা দেখতে চাইলেন হেনরি।

রন্টজেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করছেন তখন হেনরি বেকরেল ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক হন। সঙ্গে গবেষণাও চলে। প্রতিপ্রভার ওপর লেখেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। কিন্তু আসল পরীক্ষায় তিনি ব্যর্থ।

কোন পরীক্ষা?

ওই যে, প্রতিপ্রভা বিকিরণ করে যেসব বস্তু, সেগুলো কি এক্স রশ্মি বিকিরণ করে? বেকরেল এটা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফল আসে নেগেটিভ- কোনো প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী পদার্থেই তিনি এক্স রশ্মির হদিস পেলেন না।

১৮৯৫ সালের শুরুতে পয়েনকেয়ার একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এক্স রশ্মি নিয়ে। সেই প্রবন্ধে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে। বলেন, যেসব বস্তু তীব্র প্রতিপ্রভা বিকিরণ তারা কি দৃশ্যমান আলো আর এক্স-রে একই সঙ্গে বিকিরণ করে?

পয়েনকেয়ারের এই প্রশ্নটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন বেকরলে, নতুন করে শুরু করেন তাঁর পরীক্ষা। এবার তিনি পরীক্ষার নতুন হিসেবে ব্যবহার করলেন পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট। এটা ইউরোনিয়ামের একটা লবণ।

তখনকার যুগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকরশ্মি নিঃসরণ অর্থাৎ প্রতিপ্রভা বিকিরণকারী যৌগগুলোকে ফসফরোসেন্ট পদার্থ বলতেন বিজ্ঞানীরা। এই যৌগগুলো আলো বা তাপ শক্তি শোষণ করে। তারপর ধীরে ধীরে বিকিরণ করে আলো। শক্তির যোগান বন্ধ হওয়ার পরও বহুক্ষণ ধরে চলে আলো বিকিরণ প্রক্রিয়া। আরেক ধরনের পদার্থ আছে। ফ্লোরোসেন্ট। শক্তির জোগান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে এদের বিকিরণও বন্ধ হয়ে যায়। বেকরেল  যেটা ব্যবহার করেন, সেটা হলো পটশিয়াম ইরোনাইল সালফেটের একটি ক্রিস্টাল।

এটা এক ধরনের ফসফরোসেন্ট যৌগ। তাই এটা শক্তি শোষণ করে অনেক্ষণ ধরে আলোক রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। বেকরেল দেখতে চেয়েছিলেন এই ক্রিস্টাল যখন আলোকরশ্মি বিকিরণ করে তখন অন্য আলোর পাশাপাশি এক্স রশ্মিইও বিকিরণ করে কি-না।
বেকরেল একটা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে পুরো কালো কাগজ দিয়ে মোড়ান। তারপর সেটাকে রাখেন সূর্যের আলোতে। বেকরেল কালো কাগজটির ওপর রাখলেন পটাশিয়াম ইউরোনাইল ফসফেটের সেই ক্রিস্টাল। সূর্যের সাধারণ আলো অত মোটা কালো কাগজ ভেদ করে ঢুকতে পারবে না ফটোগ্রাফিক প্লেটে। ঢুকতে পারবে না ক্রিস্টাল যেসব দৃশ্যমান আলোক রশ্মি বিকিরণ করে সেগুলোও। কিন্তু ক্রিস্টাল যদি এক্স-রশ্মি বিকিরণ করে তাহলে সেটা ঢুকে পড়বে কালো কাগজ ভেদ করে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে পড়বে সেই রশ্মির ছাপ। কয়েক ঘণ্টা রোদে রেখে দিলেন সেগুলো। পরে বেকরেল সবগুলো জিনিস তুলে নিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরিতে। কালো কাগজ সরিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটটাকে ডেভেলপ করলেন।

দেখলেন, তাঁর অনুমানাই ঠিক। ফসফরোসেন্ট ক্রিস্টালটি সত্যি সত্যিই এক্স-রে বিকিরণ করেছে। সেই বিকিরণের ছাপ দেখা গেছে প্লেটে। অনুমান তো ঠিক হলো। এটা তো অন্যদেরও জানাতে হবে। তার আগে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া চাই।

এজন্য বেকরেল আরেকবার করতে চইলেন পরীক্ষাটি। সবকিছু আগের মতো করে প্রস্তুত করলেন। কিন্তু কপাল মন্দ তাঁর। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল আবহাওয়া। মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল সূর্য। সুতরাং আর এগুবে না পরীক্ষা। যতদিন আবহাওয়া ভালো নয়, ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।

কালো কাগজ মোড়ানো প্লেট আর ক্রিস্টালটাকে তুলে নিয়ে এলেন। তারপর সেগুলো ঢুকিয়ে রাখলেন ল্যাবরেটরির ড্রয়ারে। বেশ কয়েকদিন আবহাওয়া খারাপ হয়ে ছিল। তর সইছিল না বেকরেলের। কিছু একটা করতে হবে। তাই ড্রয়ারে রাখা কালো কাগজ মোড়া প্লেট, ক্রিস্টাল—বের করলেন সব। প্যাকেট খুলে পেস্নটটা ডেভেলপ করলেন। ডেভেলপ করা প্লেটের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন বেকরেল। প্লেটের ওপর ঝাপসা আলোর রেখা।

এটা এলো কোথা থেকে? আশপাশে চালু অবস্থায় কোনো এক্স-রের উত্সও নেই। তারমানে কোনো রকম শক্তি শোষণ না করেই ফসফরোসেন্ট কিস্টালটি এক্স-রে বিকিরণ করেছে! একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে!

এর ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন বেকরেল। তারপর আবিষ্কার করলেন, এই ঘটনাটির জন্য পুরো ক্রিস্টালটি নয়। দায়ী ইউরেনিয়াম পরমাণ। ক্রিস্টালের প্রতিটা অণুতে একটা করে ইউরেনিয়াম পরমাণু থাকে। সেই পরমাণুই আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক্স-রে বিকিরণ করেছে।
ইউরেনিয়ামযুক্ত আরও কিছু যৌগ নিয়েও পরীক্ষা করেছিলেন বেকরেল। সবগুলোতেই একই ফল পাওয়া গেছে। তারমানে ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিশেষ ক্ষমতা আছে রশ্মি বিকিরণ করার। তবে বেকরেল কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না বিকিরিত এই রশ্মিগুলো এক্স-রে কিনা। তাই তিনি সেই বিকিরণের নাম দিলেন ইউরেনাইল রশ্মি। পরে ফরাসী বিজ্ঞানী মেরি কুরি এ ধরনের সকল রশ্মির নাম দিলেন তেজস্ক্রিয় রশ্মি। যেসব মৌল তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকরণ করে তাদের নাম দেওয়া হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button