প্লাস্টিক পলিথিনে নদীর সর্বনাশ
সর্বনাশা প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে দেশের নদনদী, খালবিল। অপচনশীল বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী, খাল, বিলের তলদেশ। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খালের প্রবাহ, স্যুয়ারেজ লাইন। নদী ও খালের পাড় দখলেও ভূমিকা রাখছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য। নদীর পাড়ের মাটি খুঁড়লে মিলছে ১৫-২০ বছরের পুরনো পলিথিন। এতে উর্বরতা কমছে মাটির। দূষিত হচ্ছে পানি। একপর্যায়ে এই প্লাস্টিক গুঁড়ো হয়ে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে ঢুকছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে। সৃষ্টি করছে ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী রোগ। সামগ্রিকভাবে এর আর্থিক ক্ষতি গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কয়েক লাখ কোটি টাকায়। আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করার পরও আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলেছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার। বর্তমানে দেশে বছরে উৎপন্ন হচ্ছে ৮ লাখ ২১ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য। এর ৪০ ভাগ পুনর্ব্যবহার হলেও ৬০ ভাগই ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে একবার ব্যবহার্য পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়নি। আইনের এই ফাঁকের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। এদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ হলে সেটাও বন্ধ হয়নি। প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে পলিথিনের শপিং ব্যাগ। গড়ে উঠছে পলিথিনের নতুন নতুন কারখানা। তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি কারখানায় পলিথিন তৈরি হচ্ছে, যার অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়।
বাকিটা পরিবেশে পড়ে থাকে। শুধু ঢাকা শহরেই বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা সারা দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৩০ ভাগের বেশি। সরকারি তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ থেকে ১০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন করে। রাজধানীতে মাথাপিছু প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২২ কেজি পর্যন্ত। আর এই প্লাস্টিক ও পলিথিনের একটি বড় অংশের শেষ গন্তব্য হয় নদনদী ও বিভিন্ন জলাশয়ে। জার্মানির বার্লিন ভিত্তিক গবেষকদের নেটওয়ার্ক রিসার্চগেটে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী হয়ে প্রতি বছর প্রায় ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশছে বঙ্গোপসাগরে। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গায় অক্সিজেনের পরিমাণ ১ মি.লি. গ্রাম পার লিটারের থেকেও কম। যেখানে মাছ এবং মানুষের জন্য ৫ মি.লি. গ্রাম পার লিটারের প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদফতর ও ওয়েস্ট কনসার্নের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী মাত্র শতকরা ৩৬ ভাগ প্লাস্টিক
পুনর্ব্যবহার করা হয়, ৩৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায় এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য আসছে আশপাশের দেশ থেকেও। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে, সেখানে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে চীন, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটান থেকে আসছে প্রতিদিন ৭০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য। উদ্বেগের বিষয় যে, বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা প্রাণিকুল ছাড়াও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় প্রতি কেজি লবণে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যানুসারে, প্লাস্টিক দূষণের দিক থেকে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা যৌথভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত অববাহিকা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর আগে ২০১৮ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপির হিসাবে বুড়িগঙ্গা বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদীর তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। গত বছর একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার চারপাশের নদীতীরের মাটি খুঁড়ে প্রতি টন মাটিতে আধা কেজি থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক পেয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বছরের পুরনো প্লাস্টিকও ছিল। কর্ণফুলী নদীতে ২০১৮ সালের ড্রেজিংয়ের সময় ৪৮ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হয়, এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালুমাটি। ২০১২-১৩ সালে ঢাকার চার পাশের নদীর তলদেশের বর্জ্য তুলতে পদক্ষেপ নেয় সরকার। ড্রেজার দিয়ে বর্জ্যযুক্ত মাটি তুলতে গেলে পলিথিনের আটকে ভেঙে যায় ড্রেজারের ব্লেড।
ওই সময় গবেষণায় দেখা যায়, নদীর তলদেশ থেকে প্রায় ছয়-সাত ফুট নিচ পর্যন্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য জমে আছে। এসডোর গবেষণায় দেখা যায়, সিলেটের সুরমা নদীতে শুধু ২০২১ সালেই জমে ১৯ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য। পরিবেশবাদীরা বলছেন, পেট বোতলের মতো শক্ত প্লাস্টিকের একটা অংশ বর্জ্যশ্রমিকদের হাত ঘুরে পুনর্ব্যবহার হলেও পলিথিন ব্যাগ, বিভিন্ন পণ্যের প্লাস্টিকের প্যাকেট, প্লাস্টিকের থালা, গ্লাস, কাপ শতভাগই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে পরিবেশের। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। দুই দশক আগে পলিথিন নিষিদ্ধ করার আগে আকার অনুযায়ী একটা পলিথিনের ব্যাগ কিনতে হতো এক বা দুই টাকা দিয়ে। মূল্যস্ফিতি ধরলে এখন সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ১০-১৫ টাকা। অবাক করা বিষয় হলো বর্তমানে দোকানিরা পাঁচটি পণ্যের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাগ বিনামূল্যে দিয়ে দিচ্ছে। কাচের বোতলে থাকা কোমল পানীয় এখন জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক বোতলে। জুস, চিপস, বিস্কুট, মসলা, প্রশাধনী সবই এখন প্লাস্টিকে মোড়া। চায়ের দোকান থেকে কাচের কাপ সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের কাপ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, মুদি দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর; চা, কফি, জুস তথা কোমল পানীয়ের প্লাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর; প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে অবিকৃত থাকে প্রায় ৪৫০ বছর।
Hey there, You have done an excellent job. I’ll certainly
digg it and personally suggest to my friends.
I am confident they’ll be benefited from this web site.