বস্তায় ঘুষের টাকা নিতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক
আত্মগোপনে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে বিপুল অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কাছে অভিযোগ এসেছে, তিনি সিন্ডিকেট করে বস্তায় বস্তায় ঘুষের টাকা নিতেন। পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি এবং পুলিশ সুপার পদায়নে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিতেন। নিয়োগ বাণিজ্যও করতেন বেপরোয়াভাবে। বৃহস্পতিবার কমিশন এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কামালের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিষয়েও তদন্ত করা হবে। দুদক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
এজন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযোগটি অনুসন্ধান করা হচ্ছে বিশেষ অনুসন্ধান তদন্ত-৩ শাখা থেকে। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন– দুদক উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, নাছরুল্লাহ হোসাইন ও মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম।
দুদক উপপরিচালক জাকারিয়া স্বাক্ষরিত আদেশে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম সমকালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, সাবেক ওই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে ওই টাকা আদায় করা হতো। এজন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য হলেন– যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।
ঘুষের টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। এক পর্যায়ে হারুন অবসরে গেলেও মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো। এই চক্রের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কারও কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন সম্ভব ছিল না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিত এই সিন্ডিকেট।
২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে তাঁকে পদায়ন করা হয় বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হয় কামালের বাসায়। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা এনওসি দিতে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো কামালকে।
২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থা এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তার পরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
দুদক সূত্র আরও জানায়, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই সাবেক এই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদের নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করা হতো। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৫৩৫ জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ৪৩৬ জন পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক ওই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮-১২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে।