Bangladesh

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না ভারতের

গত মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্যের মর্যাদা তুলে ধরেছিলেন, এমনকি নিজের দেশকে “গণতন্ত্রের জননী” বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ভারতের পূর্বের প্রতিবেশী বাংলাদেশে মোদি সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করছে। তার উপর এই গল্পের কমেডি হলো ঢাকার শাসকরা অস্বস্তিকরভাবে ভারতের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ।

সমস্ত ডিম এক ঝুড়িতে রাখা একটি খারাপ কৌশল। বিদেশী নীতিনির্ধারকরা সচেতনভাবেই অন্যান্য দেশের সাথে লেনদেনে এই নীতি গ্রহণ না করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে এই কাজটিই করে আসছে। ভারত বাংলাদেশে নিজের ফেবারিট নিয়ে খেলেছে এবং কয়েক দশক ধরে ঢাকায় তার ফেবারিট হলো আওয়ামী লীগ। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক পক্ষ নেই যার ওপর ভারত ঝুঁকতে পারে।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের দৃঢ় সমর্থন দলটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে এবং মানবাধিকার কর্মীদের (দায়মুক্তি সহ কঠোর) আইনের অধীনে জেলে নিতে উৎসাহিত করেছে। যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে সেগুলোকে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, অগণতান্ত্রিক কার্যকারিতা সত্ত্বেও আ.লীগ সরকারের প্রতি ভারতীয় সমর্থন মাদার ইন্ডিয়া কর্তৃক ভুল সন্তানের প্রতি অন্ধ দৃষ্টিপাত করার রূপককেও হার মানায়।

২০১৪ সালে ভারত তার তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানোর জন্য পাঠায়। তখন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। আ.লীগ বিএনপির দাবি মানতে রাজি না হওয়ায় দলটি নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন সুজাতা সিং বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করাতে ব্যর্থ হন।

তিনি তখন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের কাছে যান। তিনি তাকে এই যুক্তি দেখান যে তার দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে, জামায়াত-ই-ইসলামির মতো মৌলবাদী দল ক্ষমতায় আসবে। যেখানে (আগের) নির্বাচনগুলোতে জামায়াত কদাচিৎ ৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল।

যুক্তিটি অদ্ভুত ছিল। কারণ, সুজাতার ঢাকা মিশনের মাত্র চার মাস আগেই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত জামায়াতকে অবৈধ ঘোষণা করে বলেছিল যে দলটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।

জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যা (নির্বাচনী) প্রহসনে কিছু মর্যাদা যোগ করেছিল। প্রধান সব রাজনৈতিক দলের বয়কট করা ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বী (৩০০ সদস্যের সংসদ) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করেছিল। তবে, ২০১৪ সালের মতো, সেটিতেও ব্যাপকভাবে কারচুপি হয়েছিল।

পশ্চিমা শক্তিগুলো নির্বাচনী অনিয়ম ও সহিংসতাগুলো তদন্তের আহ্বান জানালেও, মোদি অবশ্য হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে টেলিফোন করেছিলেন। তাকে অভিনন্দন জানানো অন্য আরেকটি বড় দেশ ছিল চীন। পরপর আওয়ামী লীগ শাসনের প্রতি ভারতের সমর্থনের অন্তর্নিহিত কারণ নিরাপত্তা এবং কৌশলগত উদ্বেগ।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত, যা কিনা ল্যান্ডলকড। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উক্ত অঞ্চলটিকে সমুদ্রে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কয়েক দশক ধরেই  বিদ্রোহ-বিপর্যস্ত এবং ভারত-বিরোধী বিদ্রোহী দলগুলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় বলে শোনা গেছে।

পরপর আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে এবং ওই দলগুলো যাতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করেছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, রাজনৈতিকভাবে অস্থির এবং বিদ্রোহ-প্রবণ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে শান্ত রাখার জন্য ভারতের জন্য তাই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আওয়ামী লীগের সাথে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের বন্ধুত্ব ১৯৭১ সাল থেকে। সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভারত সক্রিয়ভাবে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সহায়তা করেছিল। আ.লীগের সাথে এই সম্পর্ক তাই ব্যক্তিগত এবং আবেগেরও বটে।

এটি তারই ব্যাখ্যা- কেন নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বেশিরভাগ বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পরও ভারত বাংলাদেশে নতুন বন্ধু তৈরি করতে কষ্ট করেনি। এই অনিচ্ছার ফলে ভারত এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে সুবিধার এক অদ্ভুত বিয়ে হয়েছে। আর দুঃখের বিষয় সেটি হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল্য দিয়ে।

ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশে নিজের বাজিতে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। যদি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়, সেক্ষেত্রে ভারত সম্পৃক্ত হওয়ার মতো কোনো অংশীদার খুঁজে নাও পেতে পারে। এটি হবে বিপর্যয়কর, কারণ বাংলাদেশে ভারতের বৃহৎ অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। দেশটির সাথে তার রয়েছে বিশ্বের পঞ্চম-দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত। আর কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক এক্টরদের সাথে তাকে আলোচনা শুরু করতে হবে।

ওদিকে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব দ্রুতই বাড়ছে। ২০১৫ সালে চীন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যে অবস্থান ভারত চার দশক ধরে উপভোগ করে আসছিল। আট বছর পেরিয়ে গেছে, বাংলাদেশ এখনও ভারতের চেয়ে চীন থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে।

শুধু চীনা পণ্যই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিও চীনা অর্থে আসক্ত হয়ে পড়েছে। চীনের কাছে দেশটির মোট ঋণের বাধ্যবাধকতা ১৭.৫ বিলিয়ন ডলার, যা মূলত শ্বেতহস্তী (মেগা) অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল৷ এর সাথে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে।

এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বের করে আনতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচিতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু, আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত ছয়টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দুটি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ, যার মধ্যে একটি বেলআউটের জন্য বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ যদি আইএমএফ এর ঋণ পেতে সফল না হয়, তাহলে তার ক্ষয়প্রাপ্ত বৈদেশিক রিজার্ভ কীভাবে ধাক্কা সামলাবে তা নিয়ে বিতর্ক করা যায়।

তাছাড়া, চীনা ঋণ পরিশোধের সমস্যাও রয়েছে। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে, চীন নিজের ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য স্বল্প সময় দেয়। তাদের সুদের হারও বেশি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৭৪ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি৷  এই অর্থবছরে তা সর্বোচ্চ ৩.২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে।

বাংলাদেশের ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সত্যিকার ঝুঁকি রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে।

চলমান অস্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রকে বোধগম্যভাবেই চিন্তিত করেছে। বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন নতুন ভিসা বিধিনিষেধের নীতি ঘোষণা করেছে: “কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তিকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা হলে।”

বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে — অনেক স্থানীয় প্লুটোক্র্যাট (অর্থের কারণে যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে) তাদের অর্জিত সম্পদ মার্কিন রিয়েল এস্টেটে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। নিষেধাজ্ঞাগুলো বাংলাদেশের তথাকথিত অলিগার্কদের পশ্চিমে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রার নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার কেড়ে নেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি কঠোর ব্যবস্থা দ্বারা অনুসরণ করা হতে পারে। বাংলাদেশের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে এক বক্তৃতায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ সহনশীলতা, সুশাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক (নীতির) কেন্দ্রে বাংলাদেশের গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারত মহাসাগরে চীনের কৌশলগত অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ অবরোধের ক্ষেত্রে চীনের সমুদ্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার অথবা উভয়েরই প্রয়োজন হবে। তাই চীন বাংলাদেশে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র দেখতে চায় না। কারণ, এতে তার সব মৌসুমের বন্ধু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঝুঁকি থাকে।

বাংলাদেশে চীনকে আটকে রাখার একটাই পথ খোলা রয়েছে৷ আর তা হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তভাবে পা রাখতে দেওয়া।

Show More

8 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor