বিদায়ী অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি
দেশের ডলার সংকট মোকাবেলায় সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার বা ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার (১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন) এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি হয় ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বা ৭৬২ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে তিন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৩৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে আমদানি ব্যয়, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও বিদেশি মুদ্রার আয় মারাত্মকভাবে কমে যায়।
কিন্তু প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। এরপর আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করলে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরায় চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ কমতে শুরু করে।
এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ওপর, এতে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
ব্যাংকারদের মতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অব্যবস্থাপনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন ও অফিসিয়াল বিনিময় হার এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধানও এজন্য দায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, দেশের রপ্তানি-রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি কমেছে। তবে আগে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ, নতুন বাণিজ্য ঋণ কমে যাওয়া এবং আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় ডলার সংকট পুরোপুরি কাটছে না।
ডলার সংকট থাকার কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। তাই নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে গতি ফেরাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির চাপ কমে এসেছে। তাই এখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রয়োজন হচ্ছে না বলে জানান তারা।
জানা যায়, বিদেশের সঙ্গে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়ে গত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৪৭৫ কোটি ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৮৪৮ কোটি ডলার। এ অবস্থায় কোনো ব্যাংক যেন আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ না হয়, সে জন্য রিজার্ভ কমলেও ডলার বিক্রি করে যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৃতীয় কিস্তিসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর থেকে ঋণ পাওয়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্স গতি ফেরায় আবারও রিজার্ভ বেড়েছে। গত ৩০ জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। ২৬ জুন ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী ৩০ জুন পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন, যা ২৬ জুন ছিল ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন। নিট রিজার্ভ ৩০ জুন ছিল ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন, যা এতদিন ১৪ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে ছিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রির প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে চলে যায় দেশের রিজার্ভ। যদিও এ পরিস্থিতি থেকে রিজার্ভ যাতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না আসে, সেজন্য দুই বছর ধরেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রথমে উদ্যোগ নেওয়া হয় দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমেছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। গেল অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি কমেছে সাড়ে ১৫ শতাংশের বেশি।
এ ছাড়া আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে গত মে মাসে বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১০ থেকে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাজারের সঙ্গে ডলারের দর সমন্বয়ের প্রভাবে গত দুই মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২৫৪ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা ৪৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর মে মাসে ২৫৩ কোটি বা ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল।