বিবস্ত্র করে নারীকে ঘোরানোর ঘটনা ভারতে মোটেই বিরল নয়
ভারতে এই মাসের শুরুতেই একজন নারীকে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টা হলো, এই ধরনের শিরোনাম এ দেশে কিন্তু নতুন কিছু নয়। তবে আইনজ্ঞ এবং জেন্ডার আক্টিভিস্টদের মতে এই জাতীয় অপরাধের মোকাবিলা করার জন্য দেশে সেই অর্থে যথেষ্ঠ বলিষ্ঠ আইন নেই।
সতর্কীকরণ- এই প্রতিবেদন পাঠকদের মানসিক ভাবে বিচলিত করতে পারে।
শশীকলার (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে) বাড়িতে ১১ ডিসেম্বর যখন একদল লোক হঠাৎ ঢুকে আসে তখন ঘড়িতে বাজে রাত একটা। বছর ৪২-এর ওই নারীকে ঘর থেকে টেনে বের করে নগ্ন অবস্থায় গ্রামের চারপাশে ঘোরানো হয়। তারপর বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেধড়ক পেটানো হয়।
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা ওই নারীকে ‘শাস্তি’ দেয়ার কারণ তার ছেলে বান্ধবীর সাথে পালিয়ে গিয়েছিল।
বেলাগাভি জেলার হোসা ভান্টামুরি গ্রামের ওই প্রেমিক যুগলের বয়স যথাক্রমে ২৪ বছর এবং ১৮ বছর। যুবতীর অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়েছিল, বাগদানও হয়েছিল। যেদিন বিয়ে হওয়ার কথা তার আগের রাতে পালিয়ে যায় তারা। মেয়েটির ক্ষুব্ধ পরিবার জানতে চাইছিল দম্পতি কোথায় রয়েছে।
খবর পেয়ে ভোর চারটে নাগাদ পুলিশ গ্রামে পৌঁছে শশীকলাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিনি তখন মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। পরে ওই রাজ্যের এক মন্ত্রী দেখা করতে এলে শশিকলার স্বামী তাকে বলেছিলেন, আমি ও আমার স্ত্রী কিন্তু ওদের দু’জনের সম্পর্কের কথা জানতাম না।
এক ডজনেরও বেশি লোককে এই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়ছিল এবং একই সাথে ‘দায়িত্বে অবহেলার’ কারণে স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
খবরটি জাতীয় স্তরে শিরোনামে উঠে আসে এবং কর্তৃপক্ষের নজরেও এসেছিল বিষয়টি। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া একে ‘অমানবিক কাজ’ বলে মন্তব্য করে শশীকলাকে ন্যায় বিচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
সরকারের পক্ষ থেকে তাকে কৃষি জমি এবং অর্থও দেয়া হয়েছিল। যদিও যে লাঞ্ছনা তাকে সহ্য করতে হয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছিল সরকার।
কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রসন্ন ভারালে এবং বিচারপতি এমজিএস কমল পুলিশকে তলব করে নিজেরাই শুনানি শুরু করে বলেন, আধুনিক ভারতে এই জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে এই বিষয়টি তাদের ‘হতবাক’ করেছে।
তবে বেলাগাভির ঘটনাটি কিন্তু বিরল নয়। বরং বিগত কয়েক বছরে ভারতে বেশ কয়েকটি এই ধরনের ঘটনা শিরোনামে উঠে এসেছে।
জুলাই মাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর থেকে এমনই একটি ঘটনা বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, দু’জন নারীকে গণধর্ষণের আগে একদল পুরুষ তাদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ভয়াবহ এই আক্রমণের একটি রাজনৈতিক দিক ছিল। কুকি এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছিল মণিপুরে। কিন্তু অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা রিপোর্টে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই জাতপাত বা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে ঘটে, যেখানে নারীর দেহ প্রায়শই সহিংসতায় রক্তাক্ত হয়।
গত আগস্টে রাজস্থানে ২০ বছর বয়সী এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন নগ্ন করে ঘোরান। ২০২১ সালের জুলাই মাসে অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর গুজরাটে ২৩ বছর বয়সী এক আদিবাসী মহিলাকেও একইভাবে ‘শাস্তি’ দেয়া হয়েছিল।
২০১৫ সালের মে মাসে উত্তরপ্রদেশে পাঁচজন দলিত নারীকে নগ্ন করে বেত দিয়ে মারেন উঁচু জাতের লোকজন। কারণ ছিল ওই দলিত পরিবারের একটি মেয়ে অন্য এক দলিত ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
২০১৪ সালে রাজস্থানে ৪৫ বছরের এক নারীকে নগ্ন করে গাধার পিঠে চাপিয়ে ঘোরানো হয়। ভাগ্নেকে হত্যার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
এগুলো অবশ্য হাতেগোনা কিছু ঘটনা যা শিরোনামে এসেছে। নারীদের ওপর এই ধরনের অত্যাচারের ঘটনার সঠিক তথ্য কিন্তু নেই।
কয়েকটি ঘটনার রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, যেখানে বিরোধী দলগুলো রাজ্য সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে এই ঘটনাগুলো উত্থাপন করেছে। কিন্তু অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, পুলিশ ও আদালতে অসংবেদনশীল জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে নারীরা প্রায়ই এসব অপরাধের কথা জানান না।
আইনজীবী এবং অধিকার কর্মী সুকৃতি চৌহান বলেন, লজ্জার কারণে নারীদের ওপর হামলার ঘটনা কমই রিপোর্ট করা হয়। পরিবারগুলো এগিয়ে আসে না কারণ এটি সম্মানের বিষয় এবং এই ঘটনার শিকার নারীরা সমর্থন পায় না বা অভিযোগ দায়ের করার জন্য যে সুরক্ষিত পরিবেশ প্রয়োজন- সেটাও পায় না।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, বিবস্ত্র করার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘(নারীর) শালীনতা নষ্ট করতে যে আক্রমণ’ হিসেবে। রাস্তায় হেনস্থা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, অনুসরণ এবং ‘ভয়্যারিজম’-এর ঘটনাকেও ব্যাখা করা হয়েছে ওই তালিকায়।
গত বছর দেশে এ ধরনের ৮৩,৩৪৪টি মামলা নথিভুক্ত হয় যাতে ৮৫,৩০০ জন আক্রান্ত নারী ছিলেন।
এই ধরনের মামলাগুলো ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিষ্পত্তি করা হয় এবং মাত্র তিন থেকে সাত বছরের জেল হয়। যা মিজ চৌহানের মতে একেবারেই, ‘পর্যাপ্ত নয়’।
‘এটা ন্যায়বিচারের উপহাস ছাড়া কিছু নয়। শাস্তি বাড়ানোর জন্য এর সংশোধন প্রয়োজন’, বলছিলেন তিনি।
কর্ণাটক হাইকোর্টে বিচারপতিরা আরও উল্লেখ করেছেন যে বেলাগাভির ওই ঘটনায় ‘৫০-৬০ জন গ্রামবাসীকে দেখা গিয়েছিল’ … যদিও, ‘কেবল মাত্র একজন ব্যক্তি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাকেও মারধর করা হয়েছিল।’
এ ধরনের নৃশংসতা বন্ধ করতে ‘সম্মিলিত দায়বদ্ধতার’ প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বিচারকরা ১৮৩০-এর দশকের একটি মামলার কথা উল্লেখ করেন -যেখানে পুরো গ্রামকে একটি অপরাধের শাস্তি পেতে হয়েছিল। ঘটনার সময় ভারত ছিল ব্রিটিশ শাসিত।
বিচারের রায়ে তারা বলেন, ‘গ্রামের সব মানুষকে দায়িত্বশীল করতে হবে। গ্রামবাসীদের মধ্যে যে কোনো একজন এটা থামানোর চেষ্টা করতে পারতেন।’
প্রধান বিচারপতি ভারালে মহাকাব্য মহাভারতের চরিত্র দ্রৌপদী, যাকে শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেছিলেন বস্ত্র হরণের সময়, তার উল্লেখ করে বলেন, ‘নারীদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে কারণ কোনো ভগবান বাঁচাতে আসবে না।’
চৌহান অবশ্য মনে করেন যে- এই পরামর্শটি বাস্তবসম্মত নয়।
তার কথায়, ‘আমরা দ্রৌপদী নই এবং আমাদের হাতে তুলে নেয়ার মতো কোনো অস্ত্রও নেই। এর দায়ও নারীদের ওপর বর্তায় না। যারা অন্যায় করছে, আইনের উচিত তাদের শাস্তি দেয়া। উল্টে আইন বলছে নারীদের উচিত তাদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখে নেয়া।’
তিনি আরও বলেন, “যে বার্তাটি আমাদের দিতে হবে সেটা হল পারিবারিক, জাত-পাত নিয়ে হানাহানি বা জাতিগত যুদ্ধের জন্য আমাদের শরীর ব্যবহার বন্ধ করুন। আমাদের শরীর যুদ্ধক্ষেত্র নয়।”
রিসার্চ অ্যানালিস্ট মৌমিল মেহরাজের কাজের ক্ষেত্র হল লিঙ্গ সমতা। তরুণদের নিয়ে কাজ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এক নারীর শরীরকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করার কারণ হলো এটি তার এবং তার পরিবার, জাতি ও সম্প্রদায়ের সম্মানের সাথে যুক্ত।’
তিনি বলেন, সঙ্ঘাতের সময় নারীদেরই সব কিছু সহ্য করতে হয়।’ তার মতে- এই ধরনের ঘটনাগুলোর মধ্যে ‘ভয়্যারিজম’ একটি উপাদানও রয়েছে। কারণ, তা দেখা হয়, ছবি তোলা হয় এবং ভিডিও ক্যামেরাতে বন্দীও করা হয়।
মৌমিল মেহরাজে জানিয়েছেন, বেলাগাভিতে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন নাবালকও রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই ধরনের অপরাধ এতটাই স্বাভাবিক হয়েছে যে পরবর্তী প্রজন্মও লিঙ্গভিত্তিক গতানুগতিক চিন্তা নিয়ে বড় হচ্ছে।
‘এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলার জন্য কি একটি আইনই যথেষ্ট? আমি মনে করি এর একমাত্র সমাধান হল আরো ভালোভাবে ছেলেদের বড় করে তোলা। তাদের শেখানো দরকার যে নারীর দেহকে তার সম্মানের সাথে যোগ করাটা ঠিক নয়।’
‘এটি একটি কঠিন কাজ, তবে এটি তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে। অন্যথায় নারীর প্রতি এই জঘন্য সহিংসতা অব্যাহত থাকবে’, সতর্ক করে দিচ্ছেন তিনি।