Hot

ব্যয়ের চাপে দিশাহারা সাধারণ মানুষ

দুই বছর আগে প্যাকেটের এক কেজি আটা ৪০ টাকায় কিনতেন একটি বেসরকারি স্কুলের গাড়িচালক জসিম উদ্দিন। এখন সেই আটা তাঁকে কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

কিন্তু দুই বছরে তাঁর বেতন বেড়েছে মাত্র তিন হাজার টাকা, যা তাঁর আগের বেতনের চেয়ে মাত্র ১০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বেতন বেড়েছে ১০ শতাংশ আর আটার দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

জসিম উদ্দিন জানান, আগে ৮০ টাকায় দুই কেজি আটা কিনতে পারতেন, এখন সেই আটা কিনতে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা লাগে। আগে এক কেজি চিনি কিনতে লাগত ৭০-৮০ টাকা, এখন লাগে ১৪০ টাকা। একইভাবে তেল, ডাল, মসলা, শাক-সবজিসহ সব কিছুর দামই ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিন্তু বেতন বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। জসিমের প্রশ্ন, ‘আমরা তাহলে চলব কিভাবে?’

তিনি বলেন, ‘আগে লাখ টাকার বেশি সঞ্চয় ছিল, সেটা তো ভেঙে খাওয়া শেষ। এখন প্রায় দুই লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে।

আগে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকলেও এখন খরচ কমাতে সাবলেট নিয়েছি। আগের মতো এখন আর মাছ-মাংস কিনতে পারি না। আগে পরিবার নিয়ে মাঝেমধ্যে ঘুরতে যেতাম। সেটাও এখন আর সম্ভব হয় না।’

শুধু একজন জসিম উদ্দিনই নন, দেশের বেশির ভাগ কর্মজীবী-শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থা এখন এমনই। স্বল্প মজুরিতে সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাসিক মূল্য ও মজুরির তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে (ফেব্রুয়ারি-২৩ থেকে জানুয়ারি-২৪) গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ এবং গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭.৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে ২ শতাংশ। যার কারণে দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবারই ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। আর এই ঋণের পরিমাণ গড়ে এক লাখ ৮৭ হাজার টাকা বলে উঠে এসেছে বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপে।

মূল্যস্ফীতির শুরু বৈশ্বিক কারণে হলেও সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ডলার রেট বেঁধে রেখেছি, সুদের হার বেঁধে রেখেছি, আমদানিকে আটকে রেখেছি। মূল্যস্ফীতির মধ্যেও টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছি তাহলে মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমবে।’

তিনি বলেন, ডলার রেট বেঁধে রাখায় এখন ফরমাল চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না, সুদের হার বেঁধে দেওয়ায়, ব্যাংকগুলো এখন টাকা ধার করে চলছে। আমদানিকে আটকে রাখায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ছে। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার দরকার ছিল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের প্রেসক্রিপশন ভুল ছিল। আমাদের যে পথে চলার দরকার ছিল, আমরা তার উল্টো পথে চলেছি। যার কারণে প্রায় এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। কমানো যাচ্ছে না।’

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, এটা ঠিক। তবে পরে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে কমানো যায়নি। আমরা ডলার রেট বেঁধে রেখেছিলাম, এখন ডলার সংকটে ভুগছি। আমদানিকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছি, বাজারে পণ্যের সংকটে দাম বাড়ছে। ব্যাংকে সুদের হার বেঁধে রেখেছি। এত দিন পরে এসে এখন সেটা ছেড়ে দিচ্ছি। আমরা বাজেট সামাল দিতে টাকা ছাপিয়েছি। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। আমরা এখন যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তা আরো অনেক আগে নেওয়া দরকার ছিল। তখন আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া আমরা বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছি। যার সামগ্রিক প্রভাব এই অস্বাভাবিক মূল্যষ্ফীতি। যার মাসুল গুনছে সাধারণ জনগণ।’

তিনি বলেন, উচ্চ মধ্যবিত্তরা যা ব্যয় করছে, তার চেয়ে বেশি আয় করছে। যার কারণে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মূল সমস্যায় পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। তারা সব জায়গায় ধাক্কা খাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি না কমার বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি আছে। একটি কমে তো আরেকটি আবার বাড়ে। কী করব, জোর করে ধরে নামাব? তবে একটু ধৈর্য ধরেন সব কিছু ঠিক হবে।’

বিবিএসের ভোক্তা মূল্য সূচকের তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। গত মে মাসে এক যুগের মধ্যে রেকর্ড ৯.৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। গত অক্টোবরে রেকর্ড ১২.৫৬ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়। গত বছরের বেশির ভাগ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকছি। যদিও দেশের অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই হার আরো বেশি।

অন্যদিকে একই সময় কর্মজীবী-শ্রমজীবীদের সার্বিক মজুরি বেড়েছে ৭.৪৯ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির চেয়েও ২ শতাংশের বেশি কম। ফলে দুই মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অনেকে খরচ কমাতে আগের বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার ছোট বাসা নিচ্ছেন, আবার অনেকে সাবলেট নিচ্ছেন। অনেকেই সংসার চালাতে গিয়ে ঋণে জর্জরিত হচ্ছেন।

ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে ৩৭ শতাংশ মানুষ

বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্য মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। আর ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ এক লাখ ৮৭ হাজার ৩০৮ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ প্রায় ২১০ শতাংশ বেশি। শহরের ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ চার লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ টাকা। ঢাকা বিভাগের পরিবারগুলোর ঋণ সবচেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, আমার বেতনের টাকা দিয়ে চলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে সংসারের প্রয়োজনে প্রতি মাসেই পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ করতে হচ্ছে। শহরের মধ্যে খরচের চাপে টিকতে না পেরে কেরানীগঞ্জে বাসা শিফট করতে বাধ্য হয়েছি।’ 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গবেষণার তথ্য মতে নিম্ন আয়ের মানুষ খাবারে বেশি খরচ করে। মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে এই শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রভাবিত হয়। গত কয়েক বছর ধরে মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অনেকে কিছু খাবারের ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকে সন্তানের টিউশনি বাদ দিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেকে খরচ কমাতে সন্তানের স্কুল পরিবর্তন করছে। অনেকে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়া কমিয়েছেন। কেউ কেউ এ ধরনের পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের পরিবর্তে কম পুষ্টিগুণের খাবার গ্রহণ করছে। এভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে মানুষ খাপ খাওয়াচ্ছে। ফলস্বরূপ পুষ্টি, খাদ্যের গুণগত মান, উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা সামগ্রিকভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

কমেছে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ

নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, পরিবারের খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে মা ও শিশু। দামের কারণে খাবার কম কিনলে কম খায় মা ও শিশু। এতে তারা অপুষ্টিতে পড়বে। এ ছাড়া বয়স্করাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী খাবার না পেলে মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়। অল্প কিছুদিনের জন্য অপুষ্টির শিকার হলে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার পর তা রিকভার করা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগলে সেটি আর পূরণ করা যায় না।

অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতি হলো এক ধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি হলে কারো কাছে হাত পাততে হয় না। নিজেদের ক্রয়ক্ষমতা দিয়েই বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কেনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট একটু উল্টো। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, সে হারে মজুরি বাড়ছে না। সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি সূচক ২.৯ শতাংশ কম হওয়ায় দিনমজুর ও শ্রমিকদের আয় বা মজুরি বাড়লেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে আয় বাড়েনি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। একটা রেস্টুরেন্টে মানুষ কী কিনতে পারে। সেখানে গিয়ে মানুষ বেশি খরচ করবে সেটাও সম্ভব নয়। একই দাম দিয়ে অল্প একটু জিনিস কিনতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্য দেশগুলো পারলে আমরা কেন পারব না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button