International

ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পেছনের নাটকীয় গল্প

তবে অশোক কুমারের দাবি, কিছু চীনা প্রযুক্তি প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। কিছু ক্ষেত্রে চীনা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়েছে এবং কর্মতৎপরতা বা পারফরম্যান্স ছিল গড়ের নিচে।

২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, ভারতের জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে ভয়াবহ এক হামলায় নিহত হন ২৬ জন সাধারণ মানুষ। হামলার ঠিক পরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত। প্রতিশোধমূলক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টা আঘাতে পাকিস্তান ভূপাতিত করে ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান। এই অভূতপূর্ব সফলতায় হঠাৎ প্রশ্ন উঠল, পাকিস্তানের পক্ষে এত নিখুঁতভাবে ভারতীয় বিমান ধরাশায়ী করা সম্ভব হলো কিভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় সামরিক মহলের আঙুল উঠে গেল চীনের দিকে। পর্দার আড়ালে ছিল বেইজিংয়ের উপগ্রহ আর রাডারের গোপন সমন্বয়। এমনই দাবি নয়াদিল্লির।

পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যদের সাহস, প্রশিক্ষণ ও সর্তকতাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চায় নয়াদিল্লি। ভারত সরকার ও তার সহযোগীদের সুরে এমন বার্তাই ফুটে উঠতে চায়।

ডিফেন্স সিক্যুরিটি এশিয়ার প্রতিবেদনও একই সুর। যেমন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর জয়েন্ট ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ (সেনজোস)’-এর মহাপরিচালক অশোক কুমার একটি বিস্ফোরক দাবি করেছেন, চীন সরাসরি পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। উপগ্রহের অবস্থান বদলানো, রাডার পুনর্সংযোজন মতো কাজসহ সবকিছুতেই বেইজিংয়ের হাত ছিল।

তার কথায়, যেকোনো আকাশপথে ভারতীয় অভিযান শুরু হলে, পাকিস্তান তা আগেভাগেই জানতে পারছিল।

অর্থাৎ শুধু যুদ্ধাস্ত্র নয়, গোয়েন্দা নজরদারিতেও পাকিস্তানকে হাতে ধরে সাহায্য করেছে চীনের সামরিক পরামর্শকরা। এই সহায়তার ফলেই পাকিস্তান ভারতীয় বিমান চলাচল এবং সেনা মোতায়েনের গতিবিধি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ রিয়াল টাইমে ধরতে সক্ষম হয়।

চীনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তিতে।

অশোক কুমারের বক্তব্যে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে, চীন পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজেদের উন্নত প্রযুক্তির ‘মাঠ পরীক্ষা’র সুযোগ হিসেবে দেখেছে। বিশেষ করে উপগ্রহ-ভিত্তিক আগাম সতর্কীকরণ (এয়ারলি ওয়ার্নিং) ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি ও পার্বত্য অঞ্চলে নজরদারি পদ্ধতির কার্যকারিতা যাচাই করাই ছিল বেইজিংয়ের মূল লক্ষ্য।

তবে অশোক কুমারের দাবি, কিছু চীনা প্রযুক্তি প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। কিছু ক্ষেত্রে চীনা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়েছে এবং কর্মতৎপরতা বা পারফরম্যান্স ছিল গড়ের নিচে।

অবশ্য তিনি গড়ের নিচে না হলে ভারতের জন্য আরো কতটা মারাত্মক হতো সে কথা বলেননি। বা বলতে ভুলে গেছেন।

রাফায়েলের মতো অতি আধুনিক তিন বিমানসহ এক ঘণ্টার আকাশ যুদ্ধে ভারত হারিয়েছে ছয় বিমান। চীনা ব্যবস্থা গড়ের নিচে না হলে হারানো বিমানের সম্ভাব্য সংখ্যা কত হতো? অশোক কুমারকে সে প্রশ্ন করার স্বাদ জাগবে অনেকেরই!

‘ইয়াওগান’ উপগ্রহেরর ছায়া ভারতের আকাশে এবং একে বলা হচ্ছে ‘ভিনদেশী চোখের নিচে’ পড়েছে নয়াদিল্লি। চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপগ্রহ নজরদারি ব্যবস্থার নাম ‘ইয়াওগান’। এই উপগ্রহ-নেটওয়ার্কে রয়েছে অপটিক্যাল, রাডার ও ইলেকট্রনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তির সমন্বয়। এরই মধ্যে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কক্ষপথে পাঠানো হয় ইয়াওগান-৪১, একটি ভূ-স্থির কক্ষপথে স্থাপিত উপগ্রহ। এই উপগ্রহ গোটা উপমহাদেশের ওপর একটানা নজর রাখার ক্ষমতা রাখে।

চীন সরকার যদিও দাবি করে এটি ‘পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’র কাজে ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্য ও দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি ‘দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য’ উপগ্রহ। অর্থাৎ শান্তিতেও আছে সমরেও আছে। ইয়াওগান উপগ্রহ সামরিক টার্গেট শনাক্ত করতে সক্ষম, এমনকি চলমান যুদ্ধবিমান ও স্থলযানও ধরতে পারে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে।

ভারতের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা জানান, ইয়াওগান উপগ্রহগুলোর ‘ব্যান্ডউইথ’ ও ‘রেজোলিউশন’ সীমিত হলেও পাকিস্তানকে এমন নজরদারি সুবিধা দিয়েছে যা ইসলামবাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় কখনোই সম্ভব ছিল না।

পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডার চীনা রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্রের জোরে বলশালী হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান সরকার বরাবরই বলে এসেছে, তাদের এই সাফল্যের পেছনে ছিল চীনা সরবরাহকৃত রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা- বিশেষ করে জে-ওয়াই-২৭এ রাডার এবং এলওয়াই-৮০ মধ্যম পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এসব প্রযুক্তির সাহায্যে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা বলয় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে বলেই দাবি ইসলামাবাদের।

ভারতের ঘুম ভাঙছে, উপগ্রহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন দিশা খুঁজছে। পাকিস্তানের অপ্রত্যাশিত আঘাতে ভারতের প্রতিরক্ষা মহলে শোরগোল পড়ে গেছে। এখন আর শুধুই যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র নয় বরং আকাশের ওপরে, মহাকাশেই ভবিষ্যতের যুদ্ধের মাঠ গড়ে উঠছে।

চীন এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ৩৩০টি উপগ্রহ পরিচালনা করছে। এসব উপগ্রহের অনেকগুলোই সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। সেখানে ভারতের সক্রিয় উপগ্রহ সংখ্যা মাত্র ২১৮ এবং তারও বেশিভাগই বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত।

এই দু’স্তর ব্যবধান ঘোচাতে ভারত ঘোষণা করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫২টি সামরিক মানের উপগ্রহ স্থাপনের পরিকল্পনা। এতে থাকবে তাৎক্ষণিক নজরদারি, নিরাপদ যোগাযোগ ও নির্ভুল লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় বা টার্গেটিং সুবিধা।

নয়াদিল্লির হোঁচটের খবর হয়ে দেখা দিলো ন্যাভিকের ব্যর্থ উৎক্ষেপণ। মহাকাশমুখো ভারতের এই যাত্রাপথ মসৃণ নয়। ২০২৫ সালের শুরুতেই ভারত জিএসএলভি এমকে-২ রকেটের মাধ্যমে এনভিএস-০২ উপগ্রহ উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হয়। উপগ্রহটি ন্যাভিক সিস্টেমের অংশ- ভারতের নিজস্ব উপগ্রহ-ভিত্তিক নেভিগেশন ব্যবস্থা, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের জিপিএবা চীনের বাইদু-এর মতো কাজ করবে। এই ব্যর্থতা ভারতের সামরিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বড় ধাক্কা।

নয়াদিল্লির দাবি, বেইজিংয়ের কূটনৈতিক ভাষায় রয়েছে নিরপেক্ষতার মুখোশ। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং ইসলামাবাদকে যুদ্ধকালীন সহযোগিতার নয়াদিল্লির অভিযোগের জবাবে কূটনৈতিক সুরে বলেন, ভারত ও পাকিস্তান- উভয়ই চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পর থেকে চীন বরাবরই নিরপেক্ষ ও ন্যায্য অবস্থান বজায় রেখেছে, যুদ্ধবিরতি ও শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কাছে বার্তাটি স্পষ্ট- ‘আগামী যুদ্ধ শুধুই আকাশে নয়, মহাকাশ থেকেও হবে।’

ছায়াযুদ্ধের প্রহর গোনার যুগ এসে গেল। চোখের সামনে যখন যুদ্ধবিমান ধরা পড়ে, তখন আসলে সেটা অনেক আগেই ‘চোখে’ ধরা পড়ে- আর সে চোখ হয়তো আর মাটিতে নয়, আকাশের অনেক উঁচুতে, উপগ্রহের লেন্সে।

চীন শুধু পাকিস্তানকে প্রযুক্তি সরবরাহ করছে না, বরং তা ব্যবহার করেও দেখাচ্ছে- এই সত্যিটা ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পকদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ভারত মনে করছে, মহাকাশে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা এখন শুধু গর্বের বিষয় নয়, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিকে থাকার শর্ত।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles