ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা কী সত্যিই বেড়েছে?
লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই ভারতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ (ইএসি) ‘ভারতের জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ’ শীর্ষক একটি ওয়ার্কিং পেপার প্রকাশ করেছে, যার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। সেখানে এসেছে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু জনসংখ্যার কথাও। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সালের পর ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ৪৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণার মধ্যেই মুসলিম সমর্থিত বিরোধী দলের প্রার্থীরা মোদির কঠোর সমালোচনা করছে। অন্যদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন পার্টি মোদির দল বিজেপি এই প্রতিবেদনকে সুষ্ঠুভাবে ক্ষতিয়ে দেখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
এখানে প্রশ্ন উঠেছে- ওয়ার্কিং পেপারটি কী দাবি করে আর প্রকৃত তথ্য কী? তাহলে কি সত্যিই ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছে? এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকেও বেশি? আর কেনই বা প্রতিবেদনটি এতো সমালোচনার মুখে পড়েছে?
ওয়ার্কিং পেপারে কি বলা হয়েছে?
প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেয়ার অফ রিলিজিয়াস মাইনরিটিস : আ ক্রস কান্ট্রি অ্যানালিসিস’, যেখানে নানা দেশের জনসংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অংশ নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হিন্দুদের জনসংখ্যা ৭.৮২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১৯৫০ সালে দেশের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের অংশ ছিল ৮৪.৬৮ শতাংশ আর ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮.০৬ শতাংশ।’
অন্যদিকে বলা হয়েছে, ‘১৯৫০ সালে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৯.৮৪ শতাংশ ছিল মুসলমান আর ২০১৫-তে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪.০৯ শতাংশে। অর্থাৎ প্রতিবেদনের বক্তব্য, ১৯৫০ সালের তুলনায় মুসলমানদের জনসংখ্যা ৪৩.১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
গবেষণাপত্রে ১৬৭টি দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেখানে ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা প্রায় ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে শুধু মুসলমানদের সংখ্যাই বাড়েনি, বেড়েছে খ্রিস্টানদের সংখ্যাও। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১৯৫০ সালে ভারতে খ্রিস্টানদের শতকরা হার ছিল ২.২৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৩৬ শতাংশে। এই সময়ে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫.৩৮ শতাংশ।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বৌদ্ধ জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বৌদ্ধদের শতকরা হার ০.০৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ০.৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে কত শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা গবেষণাপত্রে এড়িয়ে চলা হয়েছে। গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সম্প্রদায়ে প্রায় ১৬০০ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া গবেষণাপত্রটিতে শিখ, জৈন আর পার্সিদের জনসংখ্যারও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
কিন্তু আসলে এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতাংশ নয়, বরং জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু আর মুসলমানদের অংশে কী পরিবর্তন এসেছে, তার পরিসংখ্যান।
প্রতিবেদনে দেশটিতে সংখ্যালঘু বৃদ্ধি পাওয়ায় বলা হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা শুধু নিরাপদই নয় একই সঙ্গে তারা বর্ধনশীলও। যদিও আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারতের সংখ্যালঘুরা ধর্মীয়ভাবে স্বাধীন নয়।
বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিবেদনের সমালোচনা করছেন কারণ এখানে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং হ্রাস নিয়ে যে মাপকাঠিগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো তাদের মতে সঠিক নয়।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেদনটি আরও সমালোচনার মুখে পড়েছে কারণ প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে যখন দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চলছে।
ইউনাইটেড কিংডমের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং ভিজিটিং প্রফেসর সন্তোষ মেহরোত্রা বলেছেন, এই প্রতিবেদনটি মূলত গবেষণার জন্য নয় বরং শাসকের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপটের কারণেই এই সংখ্যা কমেছে?
এই প্রতিবেদনটি একটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তবে এতে আদমশুমারির কোনো তথ্য ব্যবহার করা হয়নি। ভারতে সর্বশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে আদমশুমারি হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা হয়নি। এছাড়া মোদিও পরবর্তীতে আর নতুন করে আদমশুমারির ঘোষণা করেননি। জনসংখ্যাবিদরা সাধারণত আদমশুমারির তথ্যকে শক্তিশালী বলে মনে করেন। কারণ, জরিপের ক্ষেত্রে ছোট আকারের নমুনার ফলাফল সামগ্রিক বিষয়ের তথ্য তুলে আনতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া গবেষণার ক্ষেত্রে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ছোট আকারের নমুনা গবেষণার ফলাফলে ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাবিদ এবং মেরি স্ক্লোডোস্কা-কিউরি ফেলো আশিশ গুপ্ত বলেন, ওই প্রতিবেদনে কোনো শুমারির তথ্য যুক্ত করা হয়নি। তাই প্রকাশিত তথ্যে কোনো ভুল থাকলেও নীতিগত দিক দিয়ে কিছু করার নেই। কারণ গত ১৪ বছর ধরে ভারতে আদম শুমারি নেই।
তিনি বলেন, বাস্তবে আমরা যা দেখেছি তা হলো ভারতে হিন্দু জনগোষ্ঠী বাড়ছে। ১৯৫১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ৩ কোটি ৫৪ লাখ মুসলিম জনগোষ্ঠী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ২ লাখে। অন্যদিকে এ সময়ে হিন্দু জনগোষ্ঠী ৩০ কোটি ৩ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬ কোটি ৬ লাখ। ফলে, প্রতিবেদনটিতে ত্রুটি রয়েছে।
আশিশ গুপ্ত বলেন, এ বিষয়গুলো গবেষণা প্রতিবেদনটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রতিবেদনটি একটি ক্ষুদ্র টিলাকে পর্বত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবেদনটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটিতে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে দেখা উচিত নয়।’
মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ
অধিকাংশ হিন্দু জনগণের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে একটি তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে যা ‘জনসংখ্যা জিহাদ’ নামে পরিচিত। যেটি মনে করে মুসলমানরা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত জনসংখ্যার উৎপাদন করে থাকে।
বাস্তবে, ভারতের সরকারের তথ্য অনুসারে- ভারতে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম উর্বরতার হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। একজন মুসলিম নারীর বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষমতা ১৯৯২ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৪ দশমিক ৪১ থেকে কমে ২ দশমিক ৩৬ এ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু নারীদের বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষমতা ৩ দশমিক ৩ থেকে কমে ১ দশমিক ৯৪ এ দাঁড়িয়েছে।
আশিশ গুপ্ত বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনটি এই বিষয়টি উপেক্ষা করেছে।
মেহরোত্রা বলেন, এই সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই প্রতিবেদনটি বানিয়েছে। এছাড়া এতোদিন ধরে হিন্দুদের মনে মুসলমানদের নিয়ে যে ভয় ছিলো সেই ভয়কে কাজে লাগিয়েছে। গত ১০০ বছর ধরে হিন্দু অধিকার আইন মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে যে ভয় দেখিয়েছে প্রতিবেদনটি তারই বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে বিশ্লেষণ
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের জনসংখ্যা (৭.৮২%) সব থেকে বেশি কমেছে ভারতে। এরপরই আসে মিয়ানমার। গত ৬৫ বছরে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা কমেছে ১০ শতাংশ। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুদের হার বেড়েছে।
নরেন্দ্র মোদির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সিদ্ধান্ত, ‘বিভিন্ন মহল থেকে যে বিতর্ক তোলা হয়, তার বিপরীতে গিয়েই, নিবিড়ভাবে ২৮টি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ভারতে সংখ্যালঘুরা কেবল নিরাপদই নন, সমৃদ্ধও।’
‘দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান এবং আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে’, বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।