Bangladesh

ভোট কারচুপির ‘ওহী’ বিশেষ সংস্থা থেকে

  • নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বেঠকে ডিসি-ইউএনওরা 
  • সুষ্ঠ নির্বাচনে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব 

নির্বাচনে ভোট কারচুপির নির্দেশনা আসতো পুলিশ ও একটি বিশেষ সংস্থার কাছ থেকে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপির ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনকে এ তথ্য জানিয়েছে তৎকালীন নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। 

গত বছর ৯ ডিসেম্বর সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ৩টি জাতীয় নির্বাচনে ডিসি ও ইউএনওর দায়িত্ব পালন করা সরকারি কর্মচারিদের সঙ্গে রুদ্ধধার বৈঠক হয়। বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, বিশেষ দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করার ‘ওহী নাজিল’ হতো একটি বিশেষ সংস্থা ও পুলিশ বাহিনীর তরফ থেকে। তারা মূলত এ দুটি জায়গা থেকেই এই ধরণের নির্দেশনা পেতেন। 

ওই বৈঠকে সংস্কার কমিশন প্রধান সরকারি কর্মকর্তাদের নানা অভিজ্ঞতার কথাও শোনেন। কীভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব জানতে চাইলে ডিসি ও ইউএনওরা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত ৩টি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ডিসি ও ইউএনওদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের অভিজ্ঞতা শুনেছি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের পরামর্শ শুনেছি। 

ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে এ তিনটি নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী ডিসি ও ইউএনওরা কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন তাছাড়াও ওই বৈঠকে নির্বাচনী খুঁতও তুলে ধরা হয়।

বৈঠকে উপস্থিত সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মচারিদের একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বৈঠকে একটি দলের নির্দিষ্ট প্রার্থীকে বিজয়ী করা, ভোটের পার্সেন্টেজ বাড়ানো সর্বোপরি ভোট কারচুপির  নির্দেশ সরকারের কোন পর্যায় থেকে আসতো তা জানার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান কোন ধরণের সরকারের পক্ষে সম্ভব তা জানতে চাওয়া হয়েছে। 

২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়ায় ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বেলাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১৪ সালের ভোট নিয়ে জানতে চান সংস্কার কমিশন। পুরো প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে বেশিরভাগ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন। ডিসি হিসেবে আমাদের খুব কিছু করার ছিল না। সেটিও জানিয়েছি।  

২০১৮ সালের নির্বাচনে একটি জেলায় দায়িত্বপালন করা একজন জেলা প্রসাসক (ডিসি)  দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান আমাদের কাছে মূলত তিনটি বিষয় জানতে চেয়েছেন। সেগুলো হলো ভোট কারচুপির নির্দেশ তৎকালীন সরকারের কোন পর্যায় থেকে তাদের কাছে আসতো? সরাসরি না মাধ্যম হয়ে আসতো? ভোটের পার্সেন্টেজ কত দেখাতে হবে সেটিও কী আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো? নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তারা এগুলো কেন মানতেন, কেন প্রাতবাদ বা বিদ্রোহ করা হতো না? 

অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোন সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে? আগের সকল প্রশ্নের উত্তর একেক কর্মকর্তা আলাদা করে দিয়েছেন। তবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে সকল কর্মকর্তা একযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করেন সংস্কার কমিশনের কাছে। 

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘বৈঠকে উপস্থিত থেকে আমি বলেছি ভোট সংক্রান্ত নানা ম্যাটিরিয়ালস ভোটকেন্দ্রে যাবে সকালে এবং ভোট অনুষ্ঠিত হবে সকাল ১০টা থেকে। তাহলেই কারচুপি করার অনেক সুযোগ কমে যাবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ভোটে প্রভাবক হিসেবে বিশেষ বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সায় দিয়ে সাবেক এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে হলে দলীয় মনোনয়ন বাতিল করতে হবে।’    

২০১৮ সালে অপর আরেকটি জেলায় দায়িত্ব পালন করা এক ডিসি দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সরাসরি তাদের কাছে কোনো নির্দেশ আসতো না সেটি জানিয়েছি সংস্কার কমিশনকে। ভোটের সময় তাদের কাছে নির্দেশ আসতো সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর কাছ থেকে। পুলিশ ছাড়াও বিশেষ একটি সংস্থা বা বাহিনীর তৎপরতা থাকতো বেশি বৈঠকে জানান তিনি। সরকারের আর কোনো স্তর থেকে ভোট কারচুপির নির্দেশনা তাদের কাছে আসতো না। 

তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো আসনের ভোটে সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছ থেকেও নির্দেশনা পেতেন তারা। বেশির ভাগ নির্দেশনা একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে পেতেন তারা। তাছাড়া, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদস্থ্য কর্মকর্তার কাছ থেকে আসতো।’

বৈঠকে উপস্থিত থাকা কয়েকজন সরকারি কর্মচারি দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও থাকতো কোনো কোনো আসনের ক্ষেত্রে। মূলত ভোট কারচুপির প্রেসক্রিপশন একটি বিশেষ বাহিনী থেকে নাজিল হতো। বাকি ব্যাপারগুলো পুলিশ বাহিনীর তরফ থেকে মনিটরিং করা হতো। সে অনুযায়ী কাজ করতে হতো দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের।  

বিশেষ বাহিনী বা পুলিশের নির্দেশনা আপনারা মেনেছিলেন কেন? প্রত্যাখান কেন করেননি এমন প্রশ্ন করে বদিউল আলম জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত দায়িত্বপালনকারী ডিসি ও ইউএনওরা বলেন, ‘আমরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা হলেও নির্বাচনী সময়ে আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। তাছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অফিসিয়ালি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা বাস্তবায়নে বাহিনী তাদের কর্মকর্তাদের কথাই বেশি শোনে। ফলে ডিসিরা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকে। 

২০২৪ সালে ডিসির দায়িত্বে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন এমন আরেকজন বলেন,‘কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে, মারামারি, হানাহানির ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার/প্রটেকশনে নির্দেশ দেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নানা অজুহাতে সেখানে আসতে দেরি করেন। ভোটের দিন এ জটিলতাও দেখা দেয়। সরকারি কর্মচারীদের আইন ও বিধিবিধান মেনে কাজ করতে হয়। আমরা চাইলেও এটা করবো না, ওটা করবো না বা বিদ্রোহ করার সুযোগ থাকে না। 

বৈঠকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইলের ডিসির দায়িত্ব পালন করা আনিছুর রহমান মিঞা, পিরোজপুরে ডিসির দায়িত্ব পালন করা একে এম শামিমুল হক সিদ্দিকী ছাড়াও জামালপুর জেলার ইসলামপুরের ইউএনও মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সরিষাবাড়ির ইউএনও কাজী আবেদা গুলশান, সিলেট গোয়াইঘাটের ইউএনও আজিজুল ইসলাম, সাতক্ষিরা সদর  ইউএনও আছাদুজ্জামান, পটুয়াখালী বাউফল ইউএনও এ বি এম সাদিকুর রহমান, ভোলা তজুমুদ্দিনের ইউএনও মুহম্মদ কামরুজ্জামান, কক্সবাজার টেকনাফের ইউএনও শাহ মুজাহিদ উদ্দিন, চট্টগ্রাম পটিয়া ইউএনও মোছাম্মৎ রোকেয়া পারভীন। 

২০১৮ সালে নির্বাচনে রংপুরের ডিসি এনামুল হাবীব, রাজশাহীর ডিসি ফয়েজ আহাম্মদ, খুলনার ডিসি এস এম মোস্তফা কামাল, ঢাকার ডিসি শায়লা ফারজানা, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কে এম আজম আলী, চট্টগ্রাম ডিসি ওয়াহিদুজ্জামান ছাড়াও ইউএনওদের মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল ইউএনও মৌসুমি আফরিদা, ভোলা মনফুরা ইউএনও বশির আহাম্মদ, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ইউএনও দিলরুবা আহমেদ, সাভারের ইউএনও শেখ রাসেল হাসান। 

২০২৪ সালের নির্বাচনে ডিসির দায়িত্ব পালন করা নীলফামারীর ডিসি পঞ্কজ ঘোষ, বগুড়ার ডিসি সাইফুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ডিসি মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, বরগুনার রফিকুল ইসলামসহ ৩৩ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ডাকেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button