মধ্যপ্রাচ্যে মানবতা ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত আচরণ
ইসরায়েলে পাল্টা হামলার জেরে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনয়ন। মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তে থাকা আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যে, রাতারাতি, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্ররা ইসরায়েলের উপর বর্ষিত শত শত ইরানী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এতে আহত হয়েছেন ৭৪ হাজারেও বেশি মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র একইসাথে ইসরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে এবং ফিলিস্তিনের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এবং ক্রমেই গণতন্ত্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সমর্থন আগের চেয়ে আরও বেশি সন্দেহপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সোমবার জনপ্রিয় মার্কিন অনুষ্ঠান ‘দ্য ডেইলি শো’ এর সঞ্চালক জন স্টুয়ার্ট গাজা যুদ্ধের উপর একটি ‘হিতকর নিরীক্ষণ› চালিয়েছেন এবং উল্লেখ করেছেন, ‹যুদ্ধ যেমনভাবে আগ্রাসি হচ্ছে, ন্যায়বিচারকে নিষ্ঠুরতার মতো দেখাতে শুরু করেছে।›
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার স্বরাষ্ট্র সচিব অ্যান্থনি বিøঙ্কেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছেন, এবং বিশেষ করে, মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্যবস্তু ও দমন করার এবং ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে খাদ্য ঘাটতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার রাশিয়ার প্রচেষ্টাকে বিবেকবর্জিত হিসেবে অভিহিত করেছেন বিøঙ্কেন।
তবে, বিশ^জুড়ে তথাকথিত ‹সর্বজনীন ম‚ল্যবোধের› একটি নিয়ম-ভিত্তিক শাসন বজায় রাখার জন্য মার্কিন প্রশাসনের সাম্প্রতিক প্রতিশ্রতিগুলি কিন্তু শুধুমাত্র ইউক্রেন সংঘাত ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
ইউক্রেন এবং গাজা উভয় সঙ্ঘাতের উপর অসামঞ্জস্যপ‚র্ণ প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে স্টুয়ার্ট ইসরায়েল দ্বারা লঙ্ঘন করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিগুলি তালিকাভুক্ত করে বলেন, ‹ইউক্রেনের ক্ষেত্রে খাবারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা কোশের বা হালাল নয়। যেটির কথা বললে, যুদ্ধের কারণে গাজায় আক্ষরিক অর্থে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। আমার সন্দেহ, যুক্তরাষ্ট্র কি এটিকেও বিবেকবর্জিত মনে করছে?
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তা জন কিরবি সম্প্রতি এবং কারিন জন-পিয়েরে সম্প্রতি গাজায় আল-জাজিরা সহ গণমাধ্যমগুলিকে নিষিদ্ধ করার জন্য ইসরায়েলের প্রচেষ্টা সম্পর্কে শুধুমাত্র ‹উদ্বেগ› প্রকাশ করেছেন। অথচ, গত ছয় মাসে বিশ্বের যে কোনো জায়গার তুলনায় গাজায় বেশি সাংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন এবং একটি নতুন ইসরায়েলি আইন বলে যে, তারা হুমকি বলে মনে করে এমন গণমাধ্যমগুলি নিষিদ্ধ করতে পারে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের এই প্রহসনমূলক ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করার পরিবর্তে সরাসরি এর নিন্দা জানাননি।
ভূ-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান ঘোষণা করে বাইডেন বলেছিলেন, ‘কোনো জাতি, কোনো আগ্রাসনবাদী কোনো প্রতিবেশীর ভ‚খÐ যেনো জোর করে দখল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র বিশ্বের একটি নীতি রয়েছে। মার্কিন জনগণ কখনই সেই ম‚ল্যবোধের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার থেকে নড়বে না।’
কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র যখনই বিশ্বকে ঘোষণা দেয় যে, এমন কিছু কর্মকান্ড আছে, আমরা যেগুলির অনুমতি দেব না, ইসরায়েল সেটিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিশ^কে জানিয়ে দেয় যে, বিশ^ মোড়ল হিসেবে নিজেকে জাহির করা যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গীকার কতোটা পক্ষপাতদুষ্ট। এখন, অনেকে বলতে পারেন যে, ইসরায়েলের যুদ্ধ ইউক্রেনের থেকে একেবারেই আলাদা, যেখানে ইসরায়েল একটি আক্রমণ ও জিম্মি সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দ্ব›দ্বগুলি স্পষ্ট করতে চাইছে।
কিন্তু, ইসরায়েল ৭ মার্চের পর থেকে ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালানোর মধ্যে ২২ মার্চ ইসরায়েলি সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ২হাজার একর জমি নিজের বলে দখল করে নিয়েছে, যা গাজা নয়। সেইদিন বিøঙ্কেন আলোচনার জন্য ইসরায়েলে অবস্থান করছিলেন। তাই এটি দাবি করা যাবে না যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসায়েলের এই ভয়ঙ্কর ভূ-আগ্রাসনের কিছ্ইু জানে না এবং হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কথিত আত্মরক্ষার সাথে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে।
যুদ্ধের পর থেকে গাজায় এপর্যন্ত নিহত ৩২ হাজার ফিলিস্তিনর মধ্যে ১৩হাজারই শিশু ছিল। এবং যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে মানবতার কান্ডারী হয়ে ইসরায়েলকে যতটা হতে পারে, গাজায় সুনির্দিষ্টভাবে বিমান হামলার অনুরোধ করেছে।
দেখা যাচ্ছে যে, ইসরায়েলের সবথেকে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কথিত বিশ^জনীন নীতিগুলি তার মিত্র ইসরায়েলের সংবেদনশীলতাকে আঘাত না করার ক্ষেত্রেও চরম সতর্ক। সূত্র: আল-জাজিরা, ইউটিউব, ইন্টারনেট।