মাধ্যমিকে শিক্ষা ব্যয় ৫১% বৃদ্ধি
দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিবারে শিক্ষার্থীপ্রতি শিক্ষা ব্যয় আগের বছরের (২০২২) তুলনায় প্রাথমিকে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। আর এই ব্যয়ের সিংহভাগই ছিল প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের বেতন এবং গাইড ও নোটবই কেনা বাবদ। গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গণসাক্ষরতা অভিযান প্রকাশিত ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এবারের গবেষণার বিষয় ‘বাংলাদেশে বিদ্যালয় শিক্ষা, মহামারী উত্তর টেকসই পুনরুত্থান’। দেশের ৮ বিভাগের ১৬ জেলার ২৬ উপজেলায় ১২৮টি স্কুল এই গবেষণার আওতায় নেওয়া হয়।
এই গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিশুর শিক্ষার জন্য বার্ষিক পারিবারিক গড় ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ৮৮২ টাকা। একই সময়ে মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবারের ব্যয় ছিল ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। এসব ব্যয়ের বেশিরভাগই ছিল প্রাইভেট টিউটরের বেতন এবং গাইড ও নোটবই কেনা বাবদ। কিন্তু ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রাথমিকে শিক্ষার্থীপ্রতি ২৫ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ ব্যয় বাড়ে অভিভাবকদের।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের সহায়তা নিয়েছেন বা কোচিং সেন্টারে গিয়েছে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এই নির্ভরতার হার ছিল যথাক্রমে ৯২ ও ৯৩ শতাংশ। প্রাথমিক স্তরে ৪১ শতাংশ অভিভাবক ও মাধ্যমিক স্তরে ১৭ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, প্রতি সন্তানের জন্য তাদের মাসিক ব্যয়ের সামর্থ্য ছিল ২০০০ টাকার মধ্যে, যা ২০২২ ও ২০২৩ সালের গড় ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম।
ঝরে পড়ার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখা করত এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ৪.৫ শতাংশ ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ২০২০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত তাদের ৭০ শতাংশ এমপিওভুক্ত ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রায় ২১ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও এনজিও পরিচালিত স্কুলে পড়ালেখা করে। ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায়, ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এবং ৩ শতাংশের কিছু বেশি শিক্ষার্থী একই ক্লাসে রয়ে গেছে। তবে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
গবেষণা দেখা যায়, ২০২০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদ্রাসায় স্থানান্তরের একটি লক্ষণীয় প্রবণতা দেখা গেছে। যেসব শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে, তাদের অভিভাবককে সন্তানের জন্য মাদ্রাসা বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ধর্মীয় কারণকে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এক-পঞ্চমাংশ বলেছেন, মাদ্রাসা বাড়ির কাছে ও মহামারী চলাকালে মাদ্রাসা খোলা ছিল এবং মূলধারার স্কুলগুলো তখন বন্ধ ছিল।
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্তরে অর্ধেকেরও বেশি ৫৭ শতাংশ, আর মাধ্যমিক স্তরে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী নয়। প্রাথমিকের শিশুদের ৪১ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ঝরে পড়া ৪৯ শতাংশ বলেছে, তারা কাজ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরেপড়া মেয়েশিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। একটি ছোট অংশ বলেছে, তারা গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত। অন্যরা বলেছে, তারা কিছুই করছে না।
গবেষণা প্রতিবেদনে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিবারের শিক্ষা ব্যয়ের বোঝা কমানো, শ্রেণিকক্ষে পাঠ ও সময় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা, ঝরে পড়া ও বঞ্চিত শিশুদের ফিরিয়ে আনা, মহামারী পরবর্তী শিখন-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা, শিক্ষকদের সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান এবং আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা ও ব্লেন্ডেড পদ্ধতি চালু করা অন্যতম।
গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশের অনুষ্ঠানে এই গবেষণার মুখ্য গবেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘শিক্ষা ব্যয় বাড়ার বিষয়ের সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সম্পর্ক নেই। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমের প্রভাব আরও পরে জানা যাবে। তবে গবেষণার সময় শিক্ষকরা আমাদের বলেছেন, তারা নতুন শিক্ষাক্রম ঠিকমতো ধরতে পারছেন না। কিন্তু করোনায় শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা সরকার আমলে নিতে চাচ্ছে না। বরং ঘাটতি পূরণ না করে তারা নতুন শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেছে। তবে মূল্যায়ন নিয়ে যা হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ কাজে গবেষকদের ঠিকমতো যুক্ত করা হচ্ছে না।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী, এডুকেশন ওয়াচ চেয়ারপারসন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।