মামলা-গায়েবি মামলায় যেভাবে ধ্বংসের পথে বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবার
ভিডিও গেমের সেই গোপন আস্তানা দেখিয়ে আমান বলে, ‘র্যাব আমাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আব্বুকে নিয়ে চলে গেল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তারপর থেকেই ভাবছিলাম কীভাবে আব্বুকে বাঁচাতে পারি।’
আদনান আহমেদ আমানের বয়স ১০ বছর। বাবার সঙ্গে খেলা করেই সময় কাটাতে চায় সে। গত বছর আমানের বাবাকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জামিন পাওয়ার আগে কয়েক মাস তাকে কারাগারে থাকতে হয়। এরপর থেকে আমান উপায় খুঁজে বেড়ায় যেন তার বাবাকে আর কেউ গ্রেপ্তার করে না নিয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি ভিডিও গেম ‘মাইনক্রাফ্ট’ খেলার সময় বাবাকে বাঁচানোর একটি উপায় বের করেছে আমান। এই ভিডিও গেমে সে এমন একটি বাড়ির ডিজাইন তৈরি করেছে, যেখানে তার বাবার বসার ঘরের নিচে একটি গোপন আস্তানা আছে। আবার যদি কখনো তার বাবাকে কেউ গ্রেপ্তার করতে আসে, তাহলে তিনি ওই গোপন আস্তানায় লুকিয়ে থাকবেন এবং সবাই চলে গেলে আবার বের হয়ে আমানের সঙ্গে সময় কাটাবেন।
ভিডিও গেমের সেই গোপন আস্তানা দেখিয়ে আমান বলে, ‘র্যাব আমাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আব্বুকে নিয়ে চলে গেল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তারপর থেকেই ভাবছিলাম কীভাবে আব্বুকে বাঁচাতে পারি।’
আমানের বাবা সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. মকসুদ আহমেদ জানান, গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ভোররাতে র্যাব সদস্যরা সাদা পোশাকে এসে সিলেট নগরীর মোল্লারগাঁওয়ে নিজ বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় তার ছেলে মানসিকভাবে আহত হয়।
সিলেট শহরে জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা মিছিল করার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় মকসুদকে। গ্রেপ্তারের চার মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
মকসুদ বলেন, ‘যখনই কেউ বাসার কলিংবেল বাজায় তখনই আমার ছেলে দৌড়ে দরজায় কাছে যায়। বাইরে কে আছে সেটা না দেখেই বলে দেয়, আব্বু বাসায় নেই।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের এক সহকারী অধ্যাপকের মতে, মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত শিশুরা উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমন শিশুদের সবার সঙ্গে মিশতে, এমনকি পড়াশুনার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হতে পারে।
মকসুদের ছেলের মতো সমস্যার পাশাপাশি সারাদেশে হাজারো বিএনপি নেতাকর্মী আরও নানান সমস্যায় জর্জরিত।
তাদের অনেকে মামলার কারণে চাকরি হারিয়ে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে পরিবারের পাশাপাশি কয়েক ডজন মামলায় আইনি খরচ মেটাতে বড় অংকের ঋণের জালে জড়িয়ে গেছেন। অনেকে ঋণের টাকা ফেরত দিতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ব্যবসায়িক ক্ষতি
৩৮টি মামলার আসামি হয়ে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পলাতক ছিলেন মকসুদ।
তার দাবি, ‘আমার নামে দায়ের করা সবগুলো মামলা মিথ্যা। সাক্ষী ও বাদীরা আদালতে আমাকে শনাক্তও করতে পারেননি। যার কারণে ইতোমধ্যে ১৬টি মামলায় আমাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মকসুদ ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। মামলায় হয়রানির ভয়ে থাকা মকসুদ আগের মতো নিজের ব্যবসায় সময় দিতে পারেন না। ফলে, নিয়মিত লোকসান গুনছেন।
বিএনপির ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ২০ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে। মকসুদের মতোই তাদের প্রত্যেকের জীবন কাটছে নানা দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে।
মর্জিনা বেগমের স্বামী আব্দুল জব্বার হাওলাদার ছিলেন ঢাকার শ্রমিকদল নেতা। ২০২১ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সঠিক চিকিৎসা না পেয়েই তিনি মারা যান।
অথচ, ২০০৯ সাল পর্যন্ত তার পরিবার ছিল সচ্ছল। তাদের মালিকানাধীন দুটি যাত্রীবাহী বাস গাবতলী-সদরঘাট রুটে চলাচল করতো। এই আয় দিয়েই মূলত তাদের পরিবার চলত।
জব্বার হাওলাদার একসময় নিজে বাস চালাতেন। পরবর্তীতে নিজের সঞ্চয় ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাস দুটি কিনেছিলেন। সাভারে পাঁচ শতক জমি কিনে সেখানে সাত রুমের টিনশেড ঘরও তৈরি করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জব্বারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়। ২৯টি মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপন করেন। তার বাস দুটি আর রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘বাস দুটি কয়েক বছর পড়ে ছিল। যার কারণে সেগুলো চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ভাঙারি হিসেবে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকায় বাস দুটি বিক্রি করে দিতে হয়েছে।’
আইনি খরচ মেটাতে ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দুটি বাস ও সাভারের বাড়ি ছাড়াও পৈতৃক জমি বিক্রি করতে হয়েছে জব্বারকে।
২০২০ সালে জব্বার অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকা ঋণ করতে হয় মর্জিনাকে। যদিও জব্বার শেষ পর্যন্ত মারা যান। মর্জিনা জানান, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করেই স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছিলেন তিনি। এখন পাওনাদারদের এড়িয়ে চলেন, তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি নেই তার।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর মারা যান। তার মৃত্যুর দুই বছর পর গত ১৮ জুলাই একটি মামলায় তাকে দুই নম্বর আসামি করা হয়। মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির ১০৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আমার মৃত স্বামীও নাকি সেখানে গিয়ে ভাঙচুর করেছেন।’
ছাত্রদলের বাংলা কলেজ শাখার সাবেক সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম সুমনকেও এই মামলায় আসামি করা হয়। অথচ, এই ঘটনার নয় মাস আগেই মারা গেছেন সুমন।
মামলাটির বাদী বাংলা কলেজের কর্মকর্তা মহিদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, মামলা করার সময় তিনি কারো নাম উল্লেখ করেননি, পুলিশ নাম যোগ করেছে।
এ বিষয়ে দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আমিনুল বাশার বলেন, ‘তিনি এ কথা কেন বলেছেন, সেটা আমি জানি না। বাদী হিসেবে তিনি ওই মামলার এজাহারে সই করেছেন।’
পলাতক জীবন
গ্রেপ্তার ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার ভয়ে গত ১৯ মাস ধরে নিজ বাড়িতে যেতে পারছেন না বরিশালের গৌরনদী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেন হাওলাদার ও তার পরিবার।
মনিরের ভাষ্য, ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে স্থানীয় যুবলীগ নেতাকর্মীরা টরকী বন্দরে অবস্থিত তার দোকান হাওলাদার স্টিল ওয়ার্কস ভাঙচুর করে নগদ টাকাসহ যন্ত্রপাতি লুট করে নিয়ে যায় এবং দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য করে।
সাতটি মামলার আসামি মনির আরও বলেন, ‘হামলায় আমার প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরও মামলা করতে পারিনি ভয়ে। মামলা করলে হয়তো আমার ও আমার পরিবারের আরও ক্ষতি করতে পারে।’
ওই ঘটনার পর থেকে মনিরের ব্যবসা বন্ধ। তার ছেলে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কাজ করেন এবং তার পাঠানো টাকা দিয়েই মনিরের সংসার চলছে।
মনিরের ভাষ্য, ২০২১ সালে মনিরের বিরুদ্ধে একটি হত্যার অভিযোগ আনে পুলিশ। অথচ, হত্যার ঘটনার সময় তিনি চিকিৎসার জন্য চেন্নাই ছিলেন।
মনির বলেন, ‘আমি যখন সংবাদ সম্মেলন করে ভারতে যাওয়া-আসা এবং চিকিৎসার সব কাগজপত্র দেখাই, তারপর পুলিশ আমার নাম বাদ দিয়ে একটি সম্পূরক চার্জশিট জমা দেয়।’
চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব
২০০৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসায় সহকারী প্লাম্বার মেকানিক হিসেবে চাকরি করতেন মো. নওশাদ।
চাকরি সরকারি হওয়ায় তিনি পরিবার ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে দায়ের হওয়া সিরিজ মামলায় তার জীবনটাই মোড় নেয় ভিন্ন পথে।
বেশ কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর নওশাদকে সাময়িক বরখাস্ত করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, মামলা থেকে খালাস পেলে চাকরি ফিরে পাবেন নওশাদ।
জামিনে মুক্ত নওশাদ বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর থেকে পরিবারের ভরণপোষণ, ছেলেদের লেখাপড়া ও আইনি খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’
বন্দরনগরীর মহানগর শাখা যুবদল নেতা নওশাদের বিরুদ্ধে ৪৮টি মামলা আছে।
তিনি জানান, পুলিশ এসব মামলা করে চার্জশিট দিয়েছে এবং আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। অথচ, তিনি এসব ঘটনার অনেকগুলো সম্পর্কে জানতেনও না।
তিনি বলেন, ‘সংসারের খরচ মেটানোর জন্য অন্য কোনো কাজও করতে পারি না। গত আট বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই আদালতে যেতে হয় আমাকে।’
‘গায়েবি’ মামলা
বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের নামে মোট কতগুলো মামলা আছে তার কোনো অফিসিয়াল তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে, বিএনপির মামলা তথ্য সংরক্ষণ সেলের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৪ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখ ৪১ হাজার ৬৩৬টি মামলা হয়েছে।
এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। তবে, বিএনপির তথ্য সঠিক হলে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে প্রতি বছর ১০ হাজার বা প্রতিদিন ২৭টি করে মামলা হয়েছে।
মামলায় মৃত ব্যক্তি, অভিবাসী শ্রমিক, হজ বা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনায় বিএনপি নেতারা অনেক মামলাকে ‘গায়েবি’ মামলা বলে অভিহিত করেছেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর শেরপুরের তিনবারের সংসদ সদস্য মাহবুবুল হক রুবেলসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা করে পুলিশ।
২৫টি মামলার আসামি মাহবুবুল নতুন এই মামলা হওয়ার দুদিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন করতে ঢাকায় আসেন।
তিনি বলেন, ‘২৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ আমার ও আরও কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করে। অথচ, যে ঘটনায় মামলা করা হলো, ওই ঘটনার সময় আমি ঢাকার পথে ছিলাম।’
সাবেক এই আইন প্রণেতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় পুলিশ জানায়, তার দাবি সত্য নয়।
মকসুদ, জব্বার, মনির, মাহবুবুলসহ আরও অনেকের মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আগে ঘটনা ও অভিযুক্তদের সম্পর্কে ন্যূনতম তথ্যও সংগ্রহ করেনি।
এ ধরনের মামলার বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘মানুষকে হয়রানি করার জন্যই মিথ্যা মামলা করা হয়। আইনে এর কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও নেই।’
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রবর্তিত শতাব্দী প্রাচীন ফৌজদারি আইনের ফাঁকফোকরের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই আইন সংশোধন করেছে।’
এমনকি যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সিস্টেম প্রতিটি মামলা নিবন্ধন করার আগে যাচাই-বাছাই করে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্রাউন প্রসিকিউশনে সেইসব মামলাই নিবন্ধন করা হয় যেগুলোতে তারা জিতবে বলে আত্মবিশ্বাসী। কারণ, এসব মামলার পিছনে জনগণের অর্থ খরচ হয়।’
আইনি দিক ছাড়াও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলাগুলো কীভাবে একটি পরিবারকে আর্থিকভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে তার উদাহরণ মকসুদ, জব্বার, মনির, মাহবুবুলসহ বিরোধী দলগুলোর হাজারো নেতাকর্মী।
১৮০টি মামলার আসামি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘খুব ভয়ংকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আমাদের নেতাকর্মীরা খুব কঠিন সময় পার করছেন। তারা চরম কষ্টে তাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন। অনেকে তাদের চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কত নেতাকর্মী তো জীবিকার জন্য রিকশাও চালাচ্ছেন।’