International

মিয়ানমারে কোণঠাসা জান্তা, সতর্ক বাংলাদেশ-ভারত

বিদ্রোহীদের কাছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন মিয়ানমারের সেনাশাসক। দেশটির ৫০ শতাংশ এলাকা এখন বিদ্রোহীদের দখলে। একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ২২ শহরের ১৫টিই দখল করেছে বিদ্রোহীরা। অন্য রাজ্যেও মার খাচ্ছে সেনারা। এতে সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। তারা ঘাঁটি হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিবেশী দেশে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটির জেনারেলরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। এদিকে, গভীর অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত দেশটি এখন বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। জ্বালানি, ভোজ্যতেলসহ বহু মূল্যবান পণ্য এখান থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশটিতে। বিদ্রোহীরা বাংলাদেশের অনতিদূরের একটি শহর দখল করে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।

গত অক্টোবরে মিয়ানমারের তিনটি সশস্ত্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা জোট বেঁধে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত এই জোট সেনাবাহিনীর ডজনখানেক ফাঁড়ি দখল এবং চীন সীমান্তের কাছাকাছি উত্তরের বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা সরকারি সেনাদের পালাতে বাধ্য করে।

সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি জানিয়েছে, তারা গত সপ্তাহে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ সময় তারা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। চিন রাজ্যের এই পালেতোয়া শহরটি ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কালাদার নদীতীরে অবস্থিত। শহরটি একটি ব্যয়বহুল বন্দর প্রকল্পের অংশ, যা ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারকে সংযুক্ত করবে।

দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পরাজয়ের তালিকায় যোগ হয়েছে এ ঘটনা। আরাকান আর্মি বিবৃতিতে জানিয়েছে, পুরো পালেতোয়া এলাকায় সামরিক বাহিনীর একটি ক্যাম্পও আর অবশিষ্ট নেই।

আরাকান আর্মি পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, জান্তা এখন দেশের ৫০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বিদ্রোহী চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ) বলেছে, তারা ভারতের সীমান্তবর্তী চিন রাজ্যে পাঁচটি মূল সামরিক ঘাঁটিসহ রাজ্যের ৭০ শতাংশ দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর মিয়ানমারের শান রাজ্যের ২২টি শহরের মধ্যে ১৫টি দখল করেছে বিদ্রোহীরা। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দক্ষিণ-পশ্চিমের বাগো অঞ্চলের বাসিন্দাদের জান্তাপন্থি মিলিশিয়াদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ জন্য তাদের অর্থ ও চালের মতো প্রণোদনা দিচ্ছে। তারা অস্বীকার করলে জরিমানা দিতে বাধ্য করছে এবং এমনকি তাদের গ্রাম ধ্বংস করার হুমকিও দিচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো মরগান মাইকেল লিখেছেন, বিদ্রোহীরা গত কয়েক মাসের ঝটিকা হামলার মাধ্যমে দেশের উত্তরাংশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জান্তা বাহিনীকে উৎখাত করেছে। এতে বিরোধী গোষ্ঠী অন্যত্র নতুন করে হামলা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

ব্রাদারহুড জোট বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে যে এলাকাগুলো দখল করেছে, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করে দিয়েছে। এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, সামরিক জান্তার নিছক আপসমূলক পশ্চাৎপসরণ নয়, বরং চূড়ান্ত পরাজয় ঘটতে চলেছে।

তিনি লিখেছেন, জান্তা সরকার শান রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় আর ঢুকতে পারছে না। এতে চীনের সঙ্গে দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলের কর-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যের সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ রাজ্যের মধ্যেই সেনাই ও কুটকাইয়ের মতো বিশাল শহর দুটি অন্তর্ভুক্ত। যদিও ঘটনার প্রথমদিকে শহর দুটি ব্রাদারহুডের স্বাভাবিক টার্গেটের মধ্যে ছিল না।

মরগান লিখেছেন, দরকষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে জান্তা বহু অঞ্চল হাতছাড়া করেছে। এতে তাদের শক্তি ক্ষয় হয় এবং নিজেদের বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত ছেড়ে দিতে হয়। জান্তা সরকার ও সেনাদের কয়েকটি ঘনিষ্ঠ সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, সিনিয়র জেনারেল মিন উং হ্লাইংয়ের প্রতি ব্যাপক অসন্তোষ দেখা গেছে।

ড্রোনে কাবু জান্তা সেনা
এতদিন সামরিক বাহিনী উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন বিমানবাহিনীর সুবিধা পেয়েছিল। এ বাহিনী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শত শত ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তবে জঙ্গিবিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয়বহুল। ফলে অর্থনৈতিক সংকটে এর ব্যবহার কার্যত বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বিমানবাহিনী। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান হারে ড্রোন ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছে। তারা সামরিক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সস্তায় ড্রোন দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছে।

গার্ডিয়ান জানায়, চিন ন্যাশনাল আর্মির একটি নিবেদিত ড্রোন বিভাগ রয়েছে। এক বছরের বেশি আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউটিউবে টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে প্রযুক্তিটি পরিচালনা করতে শিখেছে তারা। ড্রোন বিভাগটি দক্ষ তরুণ যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত। তাদের কেউ কেউ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল। বিদ্রোহীরা বলছে, সস্তার ড্রোনই এখন তাদের ‘বিমানবাহিনী’।

সংকটের ধাক্কা বাংলাদেশে
মিয়ানমার সংকটে উদ্বেগ বেড়েছে বাংলাদেশে। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ২৮ সন্দেহভাজন চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে এবং মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে রাখা ৭ হাজার ৬৩৬ লিটার অকটেন, ১৩৬ লিটার ডিজেল ও ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছে। রাখাইন রাজ্য ও পালেতোয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন।
তিনি টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন বিওপি এবং সার্বিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বিওপির প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা পরিদর্শনের পাশাপাশি সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার রোধসহ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেন।

মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি বলেছেন, নভেম্বর থেকে সংঘাতের কারণে রাখাইন রাজ্যজুড়ে মানবিক সহায়তার ওপর জান্তা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এতে নিত্যপণ্যের সংকট বেড়েছে।

ভারতও বিচলিত
মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই তীব্র হয়ে ওঠার পর দেশটির বহু সেনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার জান্তার প্রায় ৬০০ সেনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রাজ্য মিজোরাম সতর্ক হয়ে উঠেছে। তারা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে এ পরিস্থিতির বিষয়ে জানিয়ে প্রতিবেশী দেশের সেনাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর তাগাদা দিয়েছে।

ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা এনডিটিভিকে জানান, মিয়ানমারের এসব সেনা মিজোরামের লঙ্গটলাই জেলায় আসাম রাইফেলসের শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর শিবির দখল করার পর এসব সেনা ভারতে পালিয়ে আসে।

এনডিটিভি জানায়, সম্প্রতি শিলংয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কাউন্সিলের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে মিজোরামের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমা। বৈঠকে লালডুহোমা তাঁর রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে থাকা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্রুত তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
এর পর ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শনিবার ঘোষণা করেছেন, সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে অবাধ চলাচল বন্ধ করবে এবং তাদের সীমান্ত বাংলাদেশের মতো সুরক্ষিত করা হবে। অমিত শাহ জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম চুক্তির আওতায় ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের উভয় পাশে বসবাসকারী মানুষ ভিসা ছাড়াই একে অপরের অঞ্চলে ১৬ কিলোমিটার প্রবেশ করতে পারে। এ সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অমিত শাহ বলেছেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত উন্মুক্ত। নরেন্দ্র মোদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে হবে। আর সে জন্যই মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমান্তেই বেড়া তৈরি করা হবে, যে রকমটা রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d