Trending

মুক্ত বাণিজ্যের যুগে গুরুত্ব পাবে না পণ্য বর্জন

ভারতীয় পণ্য বর্জনের রাজনৈতিক আহ্বান সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্ব পাবে না বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানিতে চীনের পরই দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। সবচেয়ে কাছের দেশ বলে ভারত থেকে সবচেয়ে কম সময় ও কম খরচে পণ্য আনা যায়। দেশের শিল্পেও বেশির ভাগ কাঁচামালের উৎস এই প্রতিবেশী দেশ।

এ ছাড়া কৃষি পণ্যের সংকট হলে তাদের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়।

এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। এটা বাধাগ্রস্ত করা কোনো সুচিন্তিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়। তবে বিকল্প উৎস থেকেও আমদানির সন্ধান রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এখন প্রতিবন্ধকতা উতরে মুক্ত বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বাণিজ্য বাধা দূর করে অবাধ বাণিজ্যের সুফলের জন্য। 

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আমদানি করে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। রপ্তানি করে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি করা পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট খাত সূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, এর বড় অংশ অপরিশোধিত তুলা, যা পোশাকশিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করে। স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে ওষুধ ও কাঁচামাল আমদানি করা হয়। যানবাহন এবং এর যন্ত্রাংশ, লোহা ও ইস্পাতসামগ্রী, বৈদ্যুতিক হার্ডওয়্যার, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার ও লিংকের মতো বৈদ্যুতিক গিয়ার আমদানি করা হয়।

কৃষি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যার সামগ্রী আমদানি করা হয়। দেশীয় চাহিদা পূরণে ভারত থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম যৌগ, সার ও কীটনাশক। তেলভিত্তিক পণ্যের মধ্যে ডিজেল, পেট্রোলিয়াম ও এলপিজি (তরল পেট্রল গ্যাস) আমদানি করা হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারত থেকে অনেক কৃষিপণ্য আসে।  বিশেষ করে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, মসলাজাতীয় পণ্য এমনকি সংকটে ডিম পর্যন্ত আনতে হয়। দেশটিতে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়, যা দেশের ভোগ্য পণ্যের আমদানির বড় উৎস। তাই সরবরাহ লাইনেও এটা বিশাল ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতেও এর ভূমিকা রয়েছে। তাই এটা কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে। মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আছে। ফলে ভারতের পণ্য বর্জনের আহ্বান সময়োপযোগী নয়। এ মুহূর্তে জনগণের কাছে এটা গুরুত্বের বিষয় নয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দল হিসেবে কেউ ডাক দিতেই পারে। জনগণের কাছে এটা কতটা গুরুত্ব পাবে কি না, তা দেখার বিষয়।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান একটি রাজনৈতিক স্লোগান, যা কার্যকর হবে না। দেশের মানুষ এতে কান দেবে না। কেননা ভারতের পণ্য সাশ্রয়ী। বেশির ভাগ শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্য পণ্য আমাদের আনতেই হবে।

অবাধ বাণিজ্যে বাধাগ্রস্ত করা কোনো সুচিন্তিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয় উল্লেখ করে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উতরে মুক্ত বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বাণিজ্য বাধা দূর করতে। সেখানে এই আহ্বান অবাধ বাণিজ্যের সুফল আনবে না।

তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে দ্রুত পণ্য আনা যায়। পরিবহন খরচ কম ও সময় কম লাগে। তাই ভারত থেকে পণ্য না এলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। কৃষিপণ্য অনেকটা আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সংকট হলে প্রথমেই ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এমনকি সংকটে ডিম পর্যন্ত আনতে হয়েছে ভারত থেকে।’

তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ব্যবসায় রাজনৈতিক দর্শন থাকলেও অবাধ মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করি আমরা। যেখানে অর্থ, সময় ও সুবিধা বেশি, সেখান থেকেই ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করবেন। এসব বিবেচনায় ভারত আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমদানি গন্তব্য। তাই রাজনৈতিক বর্জনের ডাকে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটা অনেকটাই ব্যক্তিগত বিষয়।’

আইবিসিসিআই তথ্য অনুসারে, এশিয়ার মধ্যে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে বাংলাদেশি রপ্তানি প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে, ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করা শীর্ষ তিনটি পণ্য : তুলা (মূল্য : ২৯৪ কোটি ডলার), খনিজ, তেল, জ্বালানি (মূল্য : ১০৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার) ও সিরিয়াল (মূল্য : ১৫৭ কোটি ডলার)।

ভারতের শীর্ষ আমদানির মধ্যে রয়েছে অশোধিত তেল, কয়লা, হীরা, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, রাবার, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস এবং যন্ত্রপাতি, যা সব পণ্য আমদানির ৮২ শতাংশ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button