International

মোদির একদলীয় রাষ্ট্রের স্বপ্ন প্রত্যাখ্যান ভারতীয় ভোটারের

বিরোধীদের জন্য শোকবার্তা লেখা হয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগ জরিপ অনুসারে, ভারতের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে বলে মনে করা হয়েছিল। তাতে বিনা বাধায় আইন ও সংবিধানের আমূল পরিবর্তন আনার ক্ষমতা পেয়ে যেত এ জোট।

মোদির সমালোচক এবং বিরোধীদের মতে, ভারত কার্যত একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। তবে ২০১৬ সালের ট্রাম্পের বিজয় এবং ব্রেক্সিটসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অগণিত বিপর্যয় দেখিয়েছে, মতামত জরিপ এবং বিশ্লেষকরা প্রায়ই ভয়ানক ভুল করতে পারেন।

এবারের নির্বাচনে মোদি সংসদের নিম্নকক্ষ বা লোকসভায় ৪০০ আসন জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। তবে মঙ্গলবার রাতের ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে যায়, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এমনকি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি। এক দশক আগে ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে টিকে থাকতে দীর্ঘদিনের জোটের শরিকদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে।

বিরোধী দলগুলো একে বহুত্ববাদের বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোটাররা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মোদির জনতুষ্টিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আংশিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবার বিজেপির আসন ৬৩টি কমে মোট সংখ্যা ২৪০-এ নেমে এসেছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২ আসন। বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে ২৩৫টি আসন জিতেছে।

এবারের ফলাফল মোদির জন্য একটি অবমাননাকর মুহূর্ত, যিনি ঘোষণা করেছিলেন–তিনি ঈশ্বর প্রেরিত (মহাপুরুষ)। নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বকে সমর্থকরা অপ্রতিরোধ্য বলে প্রশংসা করে আসছিলেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রতাপ ভানু মেহতা মঙ্গলবার রাতে লিখেছেন, বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ব্যর্থতা মোদির কর্তৃত্বের বুদ্বুদকে ছিঁড়ে ফেলেছে।

মোদি ‘ইতিহাসের অদম্য বাহন নন … আজ, তিনি কেবলমাত্র একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ। জনগণ তাঁকে এ বার্তাই দিয়েছে।’

মোদি আগামী ১০০০ বছরের জন্য ভারত নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে একে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে চান। তিনি সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করার তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা স্পষ্ট করেছেন। এর অংশ হিসেবে মোদি সম্প্রতি অযোধ্যায় মসজিদের জায়গায় একটি বিশাল রামমন্দির উদ্বোধন করেছেন। 

নতুন দিল্লির রাজনৈতিক ভাষ্যকার আরতী জেরাথ বলেছেন, মোদিকে এখন তাঁর সব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে কিছুটা ধীরগতিতে এগোতে হতে পারে। তিনি ভারতকে বিশ্বমঞ্চে একটি প্রধান কণ্ঠস্বর এবং হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে তাঁকে সাবধানে চলতে হবে। তিনি দেশেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।

মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদের দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। মোদির শাসনামলে ভারতের একসময়ের নিয়ন্ত্রণহীন মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতা এবং দলগুলো বেশ কিছু আইনি ও আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

সমালোচকরা বলছেন, মোদির এক দশকের শাসনে ধর্মীয় মেরূকরণ বেড়েছে। ইসলামফোবিয়া দেশের ২০ কোটির বেশি মুসলমানকে প্রান্তিক করেছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার দীর্ঘ ইতিহাসের দেশটিতে ধর্মীয় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় মোদির বিরুদ্ধে বারবার ইসলামফোবিক বক্তব্য দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়। তিনি বিদ্বেষপ্রসূত বক্তৃতা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। তিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করেন। ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক ভোটার তাঁর এ ধরনের নির্লজ্জ বাগাড়ম্বর প্রত্যাখ্যান করেছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রতাপ ভানু মেহতা বলেন, জনমত জরিপ সঠিক হলে ভারত বিজেপির অনিয়ন্ত্রিত আধিপত্যের দিকে এগিয়ে যেত। এটা এমন একটা আধিপত্য যা সমস্ত রাজনীতির সম্ভাবনা শেষ করে দেয়, সব প্রতিপক্ষকে গ্রাস করে এবং সুশীল সমাজকে তাদের অনুগত বানানোর হুমকি দিয়েছে। ভারতে এখন আবার তীব্র প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। 

ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর বিরোধী জোট আম আদমি পার্টির সঞ্জয় সিং বলেছেন, জনগণ ‘ঘৃণা ও একনায়কতন্ত্রের’ বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। এ নির্বাচনে জনগণ একটি বার্তা পাঠিয়েছে যে তারা বিজেপির ১০ বছরের শাসনে ক্লান্ত এবং পরিবর্তন চায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button