Bangladesh

রাজধানী ঢাকা যেন অভিভাবকহীন: নৈরাজ্য-অরাজকতার কবলে নগরজীবন

রাজধানী ঢাকা যেন নাগরিক যন্ত্রণা আর দুর্ভোগের শহরে পরিণত হয়েছে। নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধির জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপির্ট ট্র্যানজিট (বিআরটি) ও অসংখ্য ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে নাগরিক সুবিধা বাড়েনি বরং ক্রমান্বয়ে যন্ত্রণা বাড়ছে। রাজধানী ঢাকা মহানগরী যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে গোটা শহরের বড় বড় সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, এডিস মশা নিধন না করায় ডেঙ্গু রোগ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, চারশ বছরের পুরনো ৫৩ বছরের রাজধানী শহর অথচ এখনো পরিকল্পিত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিন্টেম গড়ে তোলা যায়নি। যন্ত্রতন্ত্র ময়লার ভাগাড়, নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুড়ি, প্রতিদিন প্রায় প্রতিটি সড়কে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট, এমনকি ফ্লাইওভারেও ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট নাগরিক জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছে। রাজধানী কার্যত এখন ভয়াবহ দুর্ভোগ, দুর্যোগ ভোগান্তির শহর রুপলাভ করেছে। অরাজকতার কবলে নগরজীবন। দেখার যেন কেউ নেই।

ডেঙ্গু জ্বর : দুই সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতায় রাজধানী ঢাকা এডিস মশার আতুর ঘরে রুপ নিয়েছে। কীট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করায় বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ডেঙ্গু রাজধানী ঢাকায় হানা দেয়। ঢাকা থেকে এখন ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বিভাগীয় শহরগুলোতে ব্যপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ইতিমধ্যে মৃত্যুতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতে রেকর্ড হয়েছে। প্রাণহানি প্রায় ৩০০। আক্রান্ত ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। শহরের পাড়া মহল্লায় গজিয়ে উঠা ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর যে হিসাব দিচ্ছে তার বাইরেও হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী ওই সব ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবের খাতায় নেই। রোগীর কাছ থেকে চার থেকে আটগুন বেশি টাকা আদায় করায় অনেক হাসপাতাল ডেঙ্গুর রোগীর তথ্য দিচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুর রোগীর সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড) অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুতে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর এটি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর যে হিসাব দিচ্ছে তার বাইরেও হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। হিসাবের খাতায় তাদের নাম নেই। অনেক হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দিচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

বৃষ্টির পানির তলিয়ে যায় : এবার বর্ষাকালে বৃষ্টি খুবই কম হচ্ছে। ২০ শ্রাবণ শুক্রবার মাঝারি আকারের বৃষ্টি হয়েছে। এতের রাজধানী ঢাকার অলি-গলিতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। গত শুক্রবার সকাল থেকে কখনও মুষলধারে আবার কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। এতেই গ্রিন রোড, পান্থপথ, ধানমন্ডি, শুক্রাবাদ, গার্ডেন রোড, কাঁঠালবাগান, আজিমপুর, সুবাস্ত, রামপুরা ব্রিজ, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, ইস্কাটন রোড, মতিঝিল, আরামবাগ, নয়াপাল্টন, শান্তিনগর, মালিবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় পানি জমে যায়। তারেক রহমান ও ডা. জোবাইদা রহমানের দেয়া আদালতের রায়ের প্রতিবাদে বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করে। সেখানে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় হাটুপানিতে দাঁড়িয়ে সমাবেশে বক্তাদের বক্তব্য শুনছেন।
ভুক্তোভোগীরা বলছেন, সামান্য বৃষ্টি হলে সড়কে পানি জমে। টানা বৃষ্টিতে গলিতে হাঁটু পানির ওপরে জমে যায়। ড্রেনের নোংরা পানি পেরিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। যা বিভিন্ন রোগ ছড়াতে পারে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই খারাপ অবস্থা। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা তলিয়ে যায়।

প্রতিদিন যানজট : রাজধানী ঢাকাকে এক সময় বলা হতো মসজিদের নগরী। এখন ঢাকা হয়ে গেছে বায়ু দুষণ, পরিবেশ দুর্ষণ, শব্দ দুষণ, আর যানজটের নগরী। বাসা থেকে বের হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে কেউ জানেন না। রাস্তায় কোন পয়েন্টে কত সময় আটকে থাকতে হবে তা আগে থেকে বোঝ যায় না। প্রতিদিন সকাল থেকেই রাজধানীতে তীব্র যানজট তৈরি হয়। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যানজটের কবলে পড়ে অনেকেরই অফিস ও গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে যানজট পরিস্থিতিও খারাপ হয়। এমনো দিন যায় কোনো সড়কে দিনভর যানজট লেগে থাকে। ১০ মিটিনের পথ যেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘন্টা। প্রতিদিন রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর, শেওড়াপড়া, কাজীপড়া, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, বিজয়সরণী, ফার্মগেট, বাংলামোটর, তেজগাঁও, কাকরাইল, নিউমার্কেট, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ি, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, পল্টন মোড়, গুলিস্তান, হানিফ ফ্লাইওভারের উপরেসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট দেখা গেছে। এসব রাস্তায় ধীর গতিতে যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়।

গণপরিবহণ নৈরাজ্য : একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজধানী হিসেবে ৫৩ পার করেছে। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে নাগরিকদের জন্য নিরাপদ গণপরিবহণ সিস্টে গড়ে তোলা হয়নি। সরকারি গণপরিবহণ বিআরটিসি এবং ব্যাক্তি মালিকানাধীন বাসে ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারের বেধে দেয়া ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুন তিনগুণ ভাড়া আদায় করা হয়; অথচ সরকারের কোনো তদারকী নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহণ ও বিআরটিসি মিলে সি-িকেট করে যাত্রীদের পকেট টাকা হচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। বিআরটিসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মালিকরা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে। প্রতিবাদ করলে সন্ত্রাসী লেলিয়ে যাত্রীদের নির্যাতন করা হয়। যাত্রীরা বাস মারিকদের হাতে জিম্মি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভাড়া নিয়ে আগের মতোই স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। প্রতিটি বাসে ভাড়ার তালিকা টঙানোর নিয়ম থাকলেও কোনো বাসে এখন আর তালিকা নেই। চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ থাকার নিয়মও কেউ মানে না। যাত্রী পেলে মাঝপথেও বাস দাঁড়াতে দ্বিধা করে না। আবার যেখানে সেখানে যাত্রী নামানো হয়। বিরতিহীন সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলেও কার্যত সব বাসই বিরতি দিয়েই চলে। সিটিংয়ের নামে ‘চিটিং’ প্রবনতার কাছেও জিম্মি যাত্রীরা। সব মিলে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চরম আকার ধারণ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী গণপরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ থেকে ৭ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু এই নিয়ম কেউ মানে না। ফার্মগেট থেকে আসাদ গেট গেলেও ভাড়া ১৫ টাকা। আবার মিরপুর গেলেও সেই ১৫ টাকা। ভুক্তভোগি যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন এক কিলোমিটার গেলে যে ভাড়া, ৫ কিলোমিটার গেলেও সেই ভাড়া। পরিবহন শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় কিলোমিটারের হিসাব হারিয়ে গেছে রাজধানীর বাসগুলো থেকে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে স্টপেজ হিসাবে ভাড়া আদায়। এ নিয়ে কোন যাত্রী কিছু বললেই কন্ডাক্টরের হুমকী শুনতে হয়। অথবা যাত্রীকে জোড় করে মাঝপথে নামিয়ে দেয়া হয়। বাস মালিক সমিতি কিছুদিন আগে ৩০টি রুটের বাসে ই টিকিটিং সিস্টেম চালু করেছিল। কিন্তু সেখানেও বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। বলা যায় গণপরিবণ সিস্টেম গড়ে না উঠায় ঢাকায় বসবাসরত মানুষ পরিবহণ সেক্টরের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button