রিজার্ভ চুরিতে সাবেক গভর্নরকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি

- রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়েছে
- সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন পেছানো হয় ৮০ বার
- গভর্নর নিয়োগের বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক দখলদারি
- বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন করার পরামর্শ
- ব্যাংক খাতের সংস্কারে কিছু সুপারিশ
- যুব বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে ১৭টি সুপারিশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর বা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি বলে অর্থনৈতিক কৌশল নির্ধারণে সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সাইবার হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬৭৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত রিজার্ভ চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। প্রসঙ্গত, রিজার্ভ চুরির ঘটনার সময় গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন আতিউর রহমান।
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত ১১ সেপ্টেম্বর টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল।
অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার কথাও বলা হয়েছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন ৮০ বার পেছানো হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিক দখলদারির মতো হয়ে গিয়েছিল। জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা করবে— এমন বিবেচনায় ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে বলা আছে, আইনপ্রণেতা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি কিংবা সরকারি চাকরি করেছেন এমন কেউ গভর্নর কিংবা ডেপুটি গভর্নর পদে আসবেন না। কিন্তু গত সরকার এ ধারা মানেনি। পেশাদার আমলাকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ; ঋণ পরিশোধের অতীত রেকর্ড ভালো না থাকা সত্ত্বেও ঋণ পুনঃতফসিল করা; করভার হ্রাস এবং আর্থিক প্রতিবেদন স্বাস্থ্যবান দেখাতে ঋণ অবলোপন করা; ব্যাংকের দুর্বল শাসনব্যবস্থা; সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া।
দুর্বল ব্যাংকের উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাংক খাতের কিছু অভূতপূর্ব ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। যেমন— ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি সরকার রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপহরণ করে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে। একই বছর ব্যবসায়ী এস আলম দেশের সাতটির বেশি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর ফলে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদে পরিবর্তন হয়। ফলে ইসলামি শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। এতে ওই ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা দেয়।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের সংস্কারেরও কিছু সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। টাস্কফোর্সের ওই প্রতিবেদনে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য, ডিজিটাল অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।
৫৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে চাঁদাবাজি বন্ধে আলাদা দল গঠন; স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা; পেশাদারদের দিয়ে সরকারি পর্যায়ে নেতৃত্ব গঠন, সরকারি সেবা সহজ করা; বাজারের চাহিদা অনুসারে শ্রমশক্তি প্রস্তুত করা; রপ্তানি বৈচিত্র্যময় করা; তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি; নিত্যপণ্যের মজুদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে এক যুগ ধরে প্রতিবছর গড়ে ২ শতাংশ হারে শ্রমশক্তি বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর কয়েক লাখ তরুণ চাকরির বাজারে আসছেন। অন্যদিকে গত দুই দশকে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তরুণদের কর্মসংস্থানের অবস্থা খারাপ হয়েছে। অর্থাৎ বিগত দিনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সামগ্রিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার আরও অনেক বেশি, ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। দেশে মোট বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৯ শতাংশই এ বয়সের। আর তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষিত, তাদের বড় অংশই বেকারত্বে ভুগছেন।
টাস্কফোর্স জানায়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে টারশিয়ারি অর্থাৎ স্নাতক পাস করা জনসংখ্যার হার অনেকটা অপরিবর্তিত ছিল। যেমন— ২০০০ সালে এই হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১০ সালে সামান্য বেড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। তবে গত এক দশকে স্নাতক পাস করা জনসংখ্যার এই হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালে স্নাতক পাস জনসংখ্যার হার বেড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছায়। কিন্তু স্নাতক পাস জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের জন্য চাকরির সুযোগ সেভাবে বাড়েনি। ফলে এই শ্রেণির বেকারত্ব বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে টারশিয়ারি পর্যায়ে বেকারত্ব ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন উচ্চশিক্ষিত (টারশিয়ারি) ব্যক্তির মধ্যে ১২ জনই বেকার অবস্থায় রয়েছেন। সে তুলনায় নিম্ন বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব কম।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। সেটি হচ্ছে, স্নাতক পাস করা তরুণদের মধ্যে ৬০ শতাংশই এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন কলেজ থেকে। তাদের মধ্যে মানবিক বিষয়ে ৩১ শতাংশ এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ৩২ শতাংশ পড়েছেন। অর্থাৎ টারশিয়ারি শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ চাকরির বাজারের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পড়ালেখা করেননি।
টাস্কফোর্স প্রতিবেদনে বলা হয়, এই তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার শ্রমবাজারে চাকরির চাহিদার সঙ্গে দক্ষতার অসংগতিও দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে যারা কাজে যুক্ত আছেন, তাদের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। এ কারণে চাকরির বাজারে কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দেশে শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই, এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
যুব বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে ১৭টি সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক কারিগরি ও ভোকেশনাল বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা। ইংরেজি ছাড়াও অন্য ভাষা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়া। তাতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।