লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, ভোগান্তিতে নিম্ন-আয়ের মানুষ
কাজে আসছে না সরকারের নেওয়া উদ্যোগ। ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলারের দামে অস্থিরতা, চাঁদাবাজি, আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ও সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
মগবাজারের নয়াটোলার বাসিন্দা রেখা আক্তার অন্যের বাসায় কাজ করেন, তার স্বামী কাজ করেন দিনমজুর হিসেবে। দুজনে মিলে প্রতি মাসে আয় করেন ১২-১৪ হাজার টাকা।
গত দুই বছরে তাদের আয় একইরকম থাকলেও ব্যয় বেড়েছে। দুই সন্তানসহ পরিবারটির এ আয় থেকে ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয় এক রুমের বাসার ভাড়া বাবদ, যেটা গত বছরও ছিল সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
খাদ্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে বাকি টাকায় সারা মাসের খরচের হিসাব মেলাতে ব্রয়লার মুরগির মাংসও কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন রেখা।
নয়াটোলার একটি মুদি দোকান থেকে ২০ টাকার ডাল কিনছিলেন রেখা আক্তার। তিনি বলেন, ডিম, মাছ, মাংস, সবজিসহ সবকিছুরই দাম বাড়তি।
‘সারাবছরই শুঁটকি মাছ, সুরমা মাছ, কখনো কখনো অল্প পরিমাণে ছোট মাছ খাওয়া হয়। এর সঙ্গে পাতলা ডালই এখন আমাদের ভরসা। দুটো সন্তানকে চাইলেও এখন আর উৎসবের সময় ছাড়া মাংস খাওয়াতে পারি না,’ বলেন তিনি।
রেখা আক্তারের মতো ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কিছু নিম্ন আয়ের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় । তারা জানান, দামের কারণে শুধু নিয়মিত তো নয়ই, মঝেমধ্যেও মাছ, মাংস (ব্রয়লার মুরগি) খাওয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া তাদের সবজিও কিনতে হয় সীমিত পরিসরে। কোনো কোনো পরিবার আবার ছোটখাটো অসুখে ওষুধের যে ব্যয়, সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে।
সীমিত আয় দিয়ে লাগামহীন সংসারের খরচের পেছনে দৌড়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না পরিবারগুলো। ফলে তাদের কষ্ট প্রতিনিয়ত বেড়েই যাচ্ছে।
সারা দেশের এক কোটি পরিবারকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, তেল ও চিনি দেয় সরকার।
কিন্তু সরাসরি বাজার থেকে যারা এসব পণ্য কিনছেন, তাদের কষ্ট প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ ও মনিটরিং বাড়িয়েও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে লাগাম টানতে পারেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পপুলেশন অ্যান্ড হাউজহোল্ড সেনসাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন ৩.১৭ কোটির বেশি এবং অতিদরিদ্রের সংখ্যা ৯৫ লাখের বেশি।
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত ‘রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি’ নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, ডলারের দামে অস্থিরতা, চাঁদাবাজি, আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ও সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো ডলারের দাম নিচ্ছে, যা আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবহনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের চাঁদাবাজির কারণে সবজি, সিন্ডিকেটের কারণে ব্রয়লার ও গরুর মাংসের দাম এবং উচ্চ শুল্কের কারণে চিনি ও খেজুরের দাম কমছে না।
বাজার বিশ্লেষণের তথ্যে দেখা যায়, এক লিটার সয়াবিনের দাম এখন ১৭৩ টাকা (১ মার্চ থেকে ১০ টাকা কমার কথা রয়েছে), যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের বছর, ২০২১ সালের মে মাসে ছিল ১৩৫ টাকা। ২০২২ সালে এর দাম ২০৫ টাকায়ও উঠেছিল।
৩২-৩৫ টাকার এক কেজির আটার প্যাকেটের দাম এখন ৫৫-৬০ টাকা, ৪০-৪৫ টাকার দেশি পেঁয়াজ এখন ১২০ টাকা, ৩০ টাকা হালির ব্রয়লার মুরগির ডিম এখন ৪৮ টাকা, ৭০ টাকার মশুর ডাল (বড় দানা) এখন ১১৫-১২০ টাকা কেজি।
এছাড়া ৪৪ টাকা কেজির মোটা চাল এখন ৫০-৫২ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি এখন ২১০-২১৫ টাকা, ২৫০ টাকার রুই মাছ এখন কিনতে হয় ৩৫০-৩৮০ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি চিনির দামও ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া খরচ বেড়েছে গরিবের তেলাপিয়া, পাঙাস কেনারও।
আর গরুর মাংসের দাম তো আকাশচুম্বী, ৫৮০ টাকার গরুর মাংস এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকা কেজি।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স সোলায়মান ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রিই কমে গেছে। দাম বাড়লে ক্রেতার মতো আমরাও বিপদে পড়ি।’
একই বাজারের এক পাইকারি বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, দুই বছর আগেও বেচাবিক্রির বাইরে মানুষের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ ছিল না। এখন এত ব্যস্ততা নেই, কারণ বিক্রিই কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশের বেশি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যারা যে সেবা দেয়, সবাই নিজেদের সেবা বা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
‘এ সময় বাড়িভাড়া, পরিবহন, পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়। পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠে, চাপে পড়ে সীমিত আয়ের মানুষ,’ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন তিনি।
গোলাম রহমান বলেন, সরকারের উচিত সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ ঠিক রাখা।
‘সরবরাহ ঠিক না রাখতে পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। যে কারণে অনেকসময় অন্য পদক্ষেপগুলো ঠিকমতো কাজ করে না,’ বলেন তিনি।
এদিকে সরকার বারবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছে, শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, বাজার মনিটরিং করছে। কিন্তু কোনোকিছুতেই প্রত্যাশিত ফল আসছে হচ্ছে না; বাজার উল্টো আচরণ করছে। সেই আঁচে পুড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সবজিও কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে; শুধু সপ্তাহ দুয়েক ধরে আলুর দাম ৩০ টাকায় নেমেছে দীর্ঘদিন পর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি একটি সভা করে ব্যবসায়ীদের নিয়ে। সেখানে এক উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ২৮.২৩ শতাংশ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ২৯ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। যদিও চাল, চিনি ও ডালের দাম বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় র-স্যুগার, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজের আমদানি কম বলে তুলে ধরা হয়।
মোহাম্মদ হোসেন রাজধানীতে রিকশা চলান ২০ বছর ধরে। এখন তার বয়স ৭০। এই বয়সে রিকশা চালাতে কষ্ট হলেও আয়ের অন্য কোনো পথ নেই। রাস্তায় খরচ বাদ দিয়ে ৫০০ টাকার মতো থাকে তার প্রতিদিনের আয়। এ টাকা পাঠিয়ে দেন রাজবাড়ি থাকা স্ত্রী ও দুই সন্তানের পরিবারে।
হোসেন বলেন, তিন বছর আগেও আয় এমনই ছিল, কিন্তু এই সময়ে বছরে সংসারের খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তার মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে, তার জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
বিবিএসের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৫৬ শতাংশে। গ্রামে এই হার ৯.৪১ শতাংশ ও শহরে ৯.৯৮ শতাংশ।
সাধারন মানুষ যখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে, তখন অনেকেই ওষুধের পেছনে খরচ কাটছাঁট করছেন। কারণ দাম বাড়ানোর আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও গত এক মাসে বাজারে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধ বিক্রেতারা জানান, অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক, কিডনি, ডায়াবেটিসের বেশ কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে।
এক বছর ধরে ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন রাজধানীর মহানগর প্রজেক্ট এলাকার একটি বাসার খণ্ডকালীন গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম (৫৬)।
রোগ শনাক্ত হওয়াার পর থেকে নিয়মিত ডায়াবেটিস ও প্রেশারের ওষুধ খেতে হয় মনোয়ারাকে। তবে দ্রব্যমূল্য ও ওষুধের দাম বাড়ায় এখন মাঝে মাঝেই ওষুধ খান না তিনি।
মনোয়ারা বলেন, ‘মানুষের বাসায় কাজ করে যা আয় করি, তা দিয়ে ঘরভাড়া ও সংসার খরচ চালানোর পর ওষুধ কেনার উপায় থাকে না। আগে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ওষুধের পেছনে মাসে এক হাজার টাকা খরচ হতো; এখন তা বেড়ে ১ হাজার ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে। সে কারণে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া হয় না।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুসারে, দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীর নিজ পকেট থেকে (আউট অভ পকেট) ব্যয় হয় ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে রোগীকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় করতে হয় শুধু ওষুধ কিনতেই।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ স্কুলের সহকারী গ্রন্থাগারিক রয়েল চন্দ্র দাস। তিনি জানান, মাসে ১৬ হাজার টাকা বেতন পান। প্রতি মাসে বাসাভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, আর ৮-৯ হাজার টাকা খরচ হয় খাবার কিনতে। এর মধ্যে বাচ্চাদের পড়ালেখা, নিজের হাত খরচ রয়েছে।
‘মাসের ১৫ দিন যেতেই নিজকে শূন্য মনে হয়। প্রতি মাসে টানাটানি লেগেই আছে,’ বলেন তিনি।
লক্ষ্মীপুর শহরে ডিজিটাল ফার্নিচার নামে একটি নকশাঘরের কর্মচারী মো. রিয়াজ বলেন, ‘মাসে ৬ হাজার টাকা বেতন পাই। কিন্ত চাল আর তরকারি কেনার পর কোনো টাকা থাকে না। বাজারে প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, খাওয়ার বাইরে খরচ করার কোনো টাকা আমার থাকে না।’