Trending

শুধু এআই নয়, যেভাবে চীনের ওষুধও বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে

দ্রুতগতিতে সাশ্রয়ী ওষুধ আবিষ্কারে এগিয়ে রয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো

ক্যান্সার চিকিৎসার বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ওষুধ ‘কিটরুডা’ ২০১৪ সালে বাজারে আসার পর থেকে মার্কিন কোম্পানি মার্ক বিপুল মুনাফা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত এই ওষুধ বিক্রি করে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। এর মধ্যে শুধু গত বছরই আয় হয়েছে ২৯.৫ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি পরীক্ষামূলক ওষুধ অভূতপূর্ব সাফল্য বয়ে এনেছে। ফুসফুসের এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় ওষুধটি রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘কিটরুডা’র তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এই ওষুধ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে গড়ে ১১.১ মাস, যেখানে ‘কিটরুডা’র ক্ষেত্রে এই সময় ছিল ৫.৮ মাস।

এই চমকপ্রদ ওষুধটি তৈরি করেছে চীনের বায়োটেক কোম্পানি আকেসো।

সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীনের অগ্রগতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে দেশটি বায়োটেক শিল্পেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। এতদিন চীন মূলত জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন, ওষুধের কাঁচামাল সরবরাহ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তবে এখন দেশটির ওষুধ উৎপাদনকারীরা সাশ্রয়ী প্রতিযোগিতামূলক ওষুধ তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বর্তমানে নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অবস্থান।

এর ফলে পশ্চিমা ওষুধ প্রস্তুতকারকরা ক্রমেই চীনের দিকে ঝুঁকছে। পেটেন্ট মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা ২০৩০ সাল নাগাদ ওষুধ বিক্রিতে বছরে প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান এলইকে-র এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই সময়কালে পশ্চিমা ওষুধ উৎপাদনকারীদের চীনের ওষুধ লাইসেন্স নেওয়ার পরিমাণ ১৫ গুণ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। গত নভেম্বরে আকেসোর অনুরূপ ওষুধের লাইসেন্স পেতে আরেক চীনা বায়োটেক প্রতিষ্ঠান লানোভা মেডিসিনসকে ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্ক।

গত বছর পশ্চিমা ওষুধ প্রস্তুতকারকরা যতগুলো বড় (৫০ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি) লাইসেন্সিং চুক্তি করেছে, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হয়েছে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে, যা ২০২০ সালের চেয়ে তিনগুণ বেশি।

চীনের সরকার প্রায় দুই দশক আগে বায়োটেক শিল্পকে কৌশলগত অগ্রাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৫ সালে দেশটির জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বড় ধরনের সংস্কার শুরু করলে এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। সংস্থাটি কর্মীর সংখ্যা বাড়ায়। পাশাপাশি মাত্র দুই বছরের মধ্যে ২০ হাজার ওষুধ অনুমোদনের আবেদন নিষ্পত্তি করে।

এছাড়া কর্তৃপক্ষ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সহজ করে; উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করার। পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষক ইমিন চুই-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংস্কারের ফলে কোনো ওষুধ মানবদেহে পরীক্ষার প্রথম ধাপের অনুমোদনের সময় ৫০১ দিন থেকে কমে মাত্র ৮৭ দিনে নেমে আসে।

এই সময়েই ‘সি টার্টলস’ নামে পরিচিত একদল চীনা বিজ্ঞানী, যারা বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, দেশে ফিরে আসেন এবং নতুন উদ্ভাবনে মনোযোগ দেন।

চীনের বিশাল বাজারও বায়োটেক শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে। সহজতর তালিকাভুক্তির নিয়ম বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে। এর ফলে ২০১৬ সালে বেসরকারি খাতে চীনের বায়োটেক খাতে বিনিয়োগ যেখানে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার ছিল, ২০২১ সালে তা বেড়ে ১৩.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

পর্যাপ্ত মেধা ও অর্থায়নের ফলে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো আর শুধু পশ্চিমা ওষুধের অনুলিপি তৈরি করছে না। তারা এখন ‘ফাস্ট-ফলোয়ার’ কৌশল নিয়েছে—অর্থাৎ বিদ্যমান ওষুধের উন্নত ও আরও নিরাপদ সংস্করণ তৈরি করছে।

সাধারণত ওষুধ তৈরির গবেষণার প্রথম ধাপ হলো কোনো রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রোটিন বা জিন শনাক্ত করা। এরপর বিজ্ঞানীরা এমন উপাদান খোঁজেন, যা ওই প্রোটিন বা জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গবেষণাধীন নতুন চীনা ওষুধের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ৪ হাজার ৩৯১-এ পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশই ‘ফাস্ট-ফলোয়ার’ ও সম্পূর্ণ নতুন। বিশেষত ক্যান্সার চিকিৎসার একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি অ্যান্টিবডি-ড্রাগ কনজুগেট (এডিসি) তৈরিতে চীনের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন এলইকে-র বিশ্লেষক হেলেন চেন।

এডিসি এমন একটি চিকিৎসাপদ্ধতি, যেখানে একটি অ্যান্টিবডিকে রাসায়নিক সংযোগের মাধ্যমে কেমোথেরাপির একটি অংশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যেহেতু চিকিৎসার মূল উপাদান আগে থেকেই বিদ্যমান, কার্যকারিতা নির্ভর করে কীভাবে সেগুলো সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে সংযুক্ত করা হচ্ছে তার ওপর। চেনের মতে, চীনা কোম্পানিগুলো এই প্রযুক্তিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে।

চীনা কোম্পানিগুলোর দ্রুত কাজ করার সক্ষমতাকে বড় সুবিধা বলে মনে করেন আকেসোর প্রতিষ্ঠাতা মিশেল শিয়া। তিনি দাবি করেন, ‘আমরা বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ দ্রুত কাজ করতে পারি।’

ওষুধ শিল্পের দীর্ঘতম ও ব্যয়বহুল ধাপ হলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যা চীনে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দ্রুততর। বিপুলসংখ্যক রোগী থাকায় পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবী পাওয়া সহজ, ফলে ট্রায়াল সম্পন্ন করাও দ্রুত হয়। এছাড়া সরকারও গবেষণায় উৎসাহ দিতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের অনুদান দেয়।

দ্রুততম ট্রায়ালের ফলে চীনা ওষুধ এখন বৈশ্বিক ওষুধ নির্মাতাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। চীনে গবেষণার মান উন্নত হওয়ায় অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোরও নজর কাড়ছে। বেশিরভাগ ক্লিনিক্যাল তথ্য চীনা রোগীদের হলেও তা বিনিয়োগকারি ও ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সম্ভাবনাময় চিকিৎসাপদ্ধতি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এছাড়া চীনের তথ্যের মানও উন্নত হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দেশটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আকেসোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল এতটাই কার্যকর ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) সরাসরি চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছে।

তবে এখনও খুব কম চীনা প্রতিষ্ঠানই সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ওষুধ বিক্রি করে। এর বদলে তারা লাইসেন্সিং চুক্তির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করে। এই পদ্ধতিতে চীনা কোম্পানিগুলো বিদেশের বাজারে ওষুধ বিপণনের অধিকার বিক্রি করে; বিনিময়ে অগ্রিম অর্থ, নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তিতে পরবর্তী অর্থপ্রাপ্তি ও বিক্রির ওপর রয়্যালটি পায়।

আরেকটি কৌশল হলো ‘নিউকো’ মডেল, যেখানে কোনো চীনা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তার ক্লিনিক্যাল সম্পদ আলাদা করে একটি স্বাধীন মার্কিন কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় ব্যবস্থাপনা দলের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও মূল চীনা প্রতিষ্ঠান আংশিক মালিকানা ধরে রাখে, যাতে ওষুধ সফল হলে শুধু রয়্যালটির ওপর নির্ভর না করে বাড়তি লাভ করতে পারে।

তবে এই অগ্রগতির মধ্যেও চীনের বায়োটেক শিল্প কিছু বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। লাইসেন্সিং চুক্তির সংখ্যা বাড়লেও বিনিয়োগ সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

২০২৪ সালে চীনা বায়োটেক খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা এখন কেবল সেই কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকছেন, যেগুলো দ্রুত নগদ অর্থ তৈরি করতে সক্ষম বা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা রাখে।

বিনিয়োগকারী জিমি ঝাং সতর্ক করে বলেছেন, ‘বর্তমানে যেসব লাইসেন্সিং চুক্তি হচ্ছে, সেগুলোর অনেকটাই অতীতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির ফসল। নতুন বিনিয়োগের অভাবে চীনের ওষুধ গবেষণা কার্যক্রম ধীর হয়ে যেতে পারে।’

চীনের উদ্ভাবন যতই চমকপ্রদ হোক, দেশটি এখন বিশ্ব রাজনীতির জটিল বাস্তবতায় পড়েছে। আমেরিকার সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম তুলনামূলকভাবে কম নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দেশটি চীনা বায়োটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় আয়ের উৎস। যদিও হাইটেক খাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তবে চীনা বায়োটেক খাত এখন পর্যন্ত সেই ঝুঁকির বাইরে।

তবে ইতিমধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পরীক্ষামূলক ওষুধের জন্য মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে কম মূল্যে লাইসেন্সিং চুক্তি করতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে সন্দিহান।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto