সংকটের চেয়ে কারসাজি বেশি
আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা লুফে নিয়েছেন বাংলাদেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। সংকট তৈরি হওয়ার আগেই সরবরাহ ঘাটতির অজুহাতে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গতকাল শনিবার রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দায়ী করছেন। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আদালত বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করলেও খুচরা বাজারে দামের কোনো প্রভাব পড়েনি।
দেশের বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, আড়তদাররা পেঁয়াজের বড় অংশ অন্যত্র সরিয়ে মজুদ সংকটের কথা বলে পাইকারি ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা হাতানোর সুযোগ নিচ্ছেন। আবার খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকে আগের কম দামে কেনা পেঁয়াজ এই সুযোগে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। এতে শুক্রবার পাইকারিতে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ১০৩ টাকা দরে। গতকাল শনিবার সকালে তা বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে।
এদিকে গতকাল হিলি বন্দর দিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মাত্র দুই ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক শহিদুল ইসলাম বলেন, ভারত সরকার কোনো রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। যেদিন তারা রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছে তার আগেই তো ভারতীয় রপ্তানিকারকদের অনেক পেঁয়াজের এলসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেন, এমনকি পুরনো এলসির বিপরীতেও পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তারা যেদিন রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করলেন কিন্তু তার আগের হওয়া এলসির সেই পণ্যগুলো তো তারা রপ্তানি করতে পারেন। কিন্তু তারা কোনো পেঁয়াজ রপ্তানি করবেন না এটি সম্পূর্ণ হঠকারী সিদ্ধান্ত।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ কারণে এই সময়ে আমাদের দেশে একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়। শুধু বন্ধের খবরেই দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিন্তু দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে পেঁয়াজ আমরা বৃহস্পতিবারে বন্দরে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা বিক্রি করেছি, সেই পেঁয়াজ তারা এখন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।’
অপর আমদানিকারক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা লোন নিয়ে, ধারদেনা করে পেঁয়াজের এলসি খুলেছি, আমাদের তো অনেক টাকা ইনভেস্ট হয়ে গেছে। এখন কবে বাতিল করব, কবে সেই টাকা আসবে, সে পর্যন্ত টাকা আটকে থাকল, এতে করে আমরা তো আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ছি।’
পেঁয়াজ আমদানি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ : ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে দাম বেড়েছে বলে মনে করেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। বিআইডিএসের শেষ অধিবেশনে অংশ নিয়ে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে। তবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে দর-কষাকষির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা দিল্লির সঙ্গে কথা বলেছি।’
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আলু, ডিম, মুরগি আমদানি বন্ধ আছে। আমদানি বন্ধ থাকলে এবং উৎপাদন কমে গেলে বাজারে সরবরাহ বিঘিœত হয়। তখন এসব খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিতেই পারেন। আবার এসব পণ্য আমদানি বন্ধ করার উদ্দেশ্য হলো, দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া। তিনি আরও বলেন, ‘বাইরে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথা শোনা যায়। এটা নিয়ে বেশি কথা বলব না। আমরা নানা ধরনের সংস্কার করছি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ল, তা তো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বাণিজ্য সচিব। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তো বাজারে গিয়ে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। মানুষ তো এসব ব্যাখ্যা বুঝবে না।
ঢাকার চিত্র : গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজারের বিভিন্ন আড়ত ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ পাইকার প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা; যা গত শুক্রবার বিক্রি হয়েছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। অন্যদিকে মতিঝিল, ফকিরাপুল ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়; যা গত বুধবার বিক্রি হয়েছে ৯৫ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে।
পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা মজুদ করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন।
জানতে চাইলে ফকিরাপুল বাজারের পেঁয়াজের ব্যবসায়ী কামাল বলেন, ‘গেল এক মাসের বেশি সময় বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হতো ১২০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে। সেই তুলনায় ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কম হওয়ায় এর চাহিদা বেশি ছিল। প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৯৬ থেকে ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছি। তবে ভারতের নিষেধাজ্ঞার খবরে এক দিনে পেঁয়াজের কেজিতে ১০০ টাকা দাম বাড়িয়েছেন পাইকাররা।’
পেঁয়াজের দাম বাড়ার জন্য আমদানিকারকদের দায়ী করে কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী তৈয়ব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমদানিকারকরা পেঁয়াজের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হতো। কিন্তু পাইকারদের অতিরিক্ত টাকা দিয়েও পেঁয়াজ পাইনি। উল্টো পেঁয়াজের জন্য তাগাদা দিলে টাকা ফেরত দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।’
এদিকে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সকাল থেকে ঢাকা মহানগর এলাকার বিভিন্ন বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তার নেতৃত্বে চারটি দল অভিযান পরিচালনা করেছে অধিদপ্তরের ৫৭টি টিম। ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের ৫৭টি টিম অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে ১৩৩ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তা ছাড়া আমরা বাজারে বাজারে গিয়ে দেখব, কত দামে এই পেঁয়াজ কেনা ছিল। আগে কম দামে পেঁয়াজ কিনে এখন চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রামের চিত্র : এদিকে চট্টগ্রাম নগরী এবং নগরীর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় গতকাল অভিযান চালিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ ও চৌমুহনী, কর্ণফুলী বাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’ তিনি জানান, দুপুরে খাতুনগঞ্জে গিয়ে দেখা যায় কয়েকটি আড়তে তল্লাশি চালিয়ে মজুদ করে রাখা ৪৯ বস্তা পেঁয়াজ পাওয়া যায়। পরে অভিযান টিমের উপস্থিতিতে ১১০ টাকা কেজিতে ক্রেতাদের কাছে এসব পেঁয়াজ বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তবে খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়ার বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘শনিবার সারা দিন খাতুনগঞ্জে মাত্র একটি পেঁয়াজের ট্রাক ঢুকেছে। বেশির ভাগ আড়তেই কোনো পেঁয়াজ নেই। যাদের কাছে কিছু পেঁয়াজ রয়েছে, তারাও সুযোগ বুঝে বেশি নাম নিতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশি পেঁয়াজ না আসা কিংবা বিকল্প দেশ থেকে আমদানি না করা পর্যন্ত এই সংকট কাটার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এদিকে পাবনার চাষিরা জানান, তিন দিনের বৃষ্টির জন্য ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলতে পারেননি তারা। এতে হাটে পেঁয়াজ কম থাকায় চাষি ও বাঁধাইকারকরা দাম বাড়িয়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতে গোনা কিছু চাষি ও বাঁধাইকারকদের ঘরে এখনো ভালো পরিমাণ পুরনো পেঁয়াজ মজুদ আছে। এরই মধ্যে কিছু মুড়ি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। বেশি দামের আশায় বাঁধাইকারকরা অল্প অল্প করে পেঁয়াজ হাটে নেন। তবে মুড়ি বা মূলকাটা পেঁয়াজ পুরোদমে বাজারে উঠলে পুরনো পেঁয়াজের দাম কমবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দিন জানান, এবার বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণে দেরি হয়েছে। ফলে তা বাজারে আসতেও কিছুটা দেরি হচ্ছে। ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পুরোদমে পেঁয়াজ সরবরাহ শুরু হলে দাম কমে আসবে।
এর আগে ২০১৯ সালে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে ১ দিনের ব্যবধানে দেশের বাজারে রেকর্ড গড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবারও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।