Bangladesh

হারানোর পথে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ আঞ্চলিক ভাষা, ভাষানীতি না থাকায় গভীর সংকটে বাংলা

বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেলেও বিশ্বজনীন হয়ে ওঠেনি। এমনকি ইংরেজির দাপটে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারও অনেকটা কোণঠাসা। সংবিধান ও আইনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারে বাধ্যবাধকতার কথা থাকলেও তা প্রতিপালন হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বাংলা ভাষার চর্চা ও উন্নয়নে হয়নি রাষ্ট্রীয় কোনো নীতি। ভাষানীতি না থাকায় ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় উচ্চ আদালতে এখনও ইংরেজি ভাষায় বিচারকাজ চলছে। বাণিজ্যিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির প্রাধান্য ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 সব মিলিয়ে গভীর সংকটে মাতৃভাষা।

প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব পাচ্ছে ইংরেজি ও আরবি ভাষা। হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা, অর্থাৎ মাতৃভাষাও। বিনোদনের নামে নাটক, সিনেমা ও গানে চলছে ভাষা বিকৃতি। যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায়। আঞ্চলিক ভাষা এখন খণ্ডিতভাবে বিকৃতি হচ্ছে। বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাষা বিকৃতি হচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবে বাংলা ভাষার পরিধি সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি স্বকীয়তা হারাচ্ছে ভাষার ঐতিহ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মাতৃভাষা ব্যবহারে দেশে এখন নীতিহীনতা চলছে। এটি দূর করতে হলে রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয়ভাবে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আগে প্রভাতফেরি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান শুরু হতো। কিন্তু এটিও এখন ইংরেজি রীতিতে মধ্যরাতে শুরু হয়। অনুরূপভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে; এটি দুঃখজনক। মৌলিক জায়গায় বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সব সরকারি অফিস, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনো দিনই বাংলা চালু করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’ এর পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান কার্যকর করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। 

সংবিধানের চারটি স্থানে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’ সংবিধানের আলোকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন করা হয় ১৯৮৭ সালে। উচ্চ আদালতও কয়েক দফা বাংলা ভাষানীতি প্রণয়নে তাগিদ দিয়েছেন। এর পরও ভাষানীতি প্রণয়নের বিষয়টি উপেক্ষিত।

জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে নিজস্ব ভাষানীতি রয়েছে। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইকুয়েডর ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোতে নিজস্ব ভাষানীতি রয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও রয়েছে নিজস্ব ভাষানীতি। উপযুক্ত ভাষানীতি প্রণয়নের কারণে নিউজিল্যান্ডের বিলীন হতে বসা মাউরি ভাষা শুধু রক্ষাই পায়নি, এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাষা হিসেবেও সে দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। ফ্রান্সে ভাষাবিষয়ক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রয়েছে ফরাসি একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত শব্দভান্ডারের বাইরে কোনো বিদেশি শব্দ সে দেশে ব্যবহার করা যায় না। সংবাদমাধ্যম কখনও নতুন শব্দ ব্যবহার করলে কৈফিয়ত দিতে হয়। ডাচ একাডেমি নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও সুরিনামের ভাষা-পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ভাষানীতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিক। তিনি সমকালকে বলেন, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও এর মর্যাদা রক্ষা করা যাচ্ছে না। জনগণের পাশাপাশি স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই এ ব্যাপারে উদাসীন। কারণ এতে তাদের স্বার্থহানির আশঙ্কা থাকে। তারা বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাকেই কার্যকর রাখতে চায়। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বজনীনতার দোহাই দিয়ে ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে।

তাঁর মতে, বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে, তা নিরসনে দ্রুত ভাষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন; যারা দ্রুততম সময়ে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করবে। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে বাংলা পরিভাষা প্রণয়ন এবং অনুবাদের দিকেও আমাদের নজর বাড়াতে হবে। 

ভাষা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইথনোলগের ২০২০ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০০টি বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটির মতে, পৃথিবীতে ৭ হাজার ১১৭টি জীবন্ত ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষার তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে সপ্তম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলায় কথা বলেন ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাভাষীর সংখ্যা ৩১ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। তবে মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান তৃতীয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির অবস্থান বাংলার পর, ষষ্ঠ স্থানে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর অবস্থান ১৮তম। 

স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত কোনো ভাষা জরিপ হয়নি। জানা যায়, ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আঞ্চলিক ভাষার জরিপ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র উদ্যোগে কার্যক্রম শুরুর পর জরিপের প্রশ্নমালাও তৈরি করা হয়। জনগণকে এই কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে। পরে শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম তিনটি উপজেলায় প্রশ্নমালার ভিত্তিতে জরিপও করেন। তিনি তখন বাংলা একাডেমির সংকলন বিভাগের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। ওই কার্যক্রম পরে সফলতার মুখ দেখেনি। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এখন বাংলা একাডেমির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটও কাজ করছে। কিন্তু তাদের ভূমিকা প্রকাশনার পাশাপাশি সেমিনার বা কর্মশালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী বলেন, বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারের দায়িত্ব শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির নয়, সরকারের সব সংস্থারই দায়িত্ব। এ জন্য পরিকল্পিত কাঠামো দরকার। যারা বাংলার পরিভাষা সৃষ্টি করবে, অনুবাদ করবে। অনুবাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুবাদ সেল রয়েছে, তারা কাজ করছে। কিন্তু সবই আলাদাভাবে হচ্ছে, এসব কাজের সমন্বয় দরকার। এ ক্ষেত্রে ভাষা কমিশন থাকলে, ভাষানীতি থাকলে সরকারের উদ্যোগ ও পরিকল্পনাগুলো একটি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। 

ভাষানীতি প্রণয়নের বিষয়ে একমত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফও। তিনি সমকালকে বলেন, দেশে অনেক নীতি আছে; কিন্তু ভাষানীতি নেই। অবশ্যই ভাষানীতি থাকা প্রয়োজন। শিশু জন্মের পরপরই যেন তার বিকাশের মাধ্যম খুঁজে পায়। শিশুর বেড়ে ওঠা এবং ভবিষ্যৎ সুগম হতে পারে এই ভাষানীতির মাধ্যমে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পাঠ্যসূচি ও বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই অনুবাদ করেছে। তবে এর সংখ্যা একশর বেশি নয়, যার বেশির ভাগই নব্বই দশকে প্রকাশিত। এর মধ্যে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্পগ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদের পাশাপাশি ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ছয়টি ভাষায় অনুবাদ করেছে। বিদেশে অবস্থানরত বাঙালির সুবিধার্থে ১৬টি ভাষা নির্বাচন করে বহুভাষী পকেট অভিধানও প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ এবং বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বানানরীতি’ প্রকাশ করলেও তা অনুসরণে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নূরুল হুদা বলেন, বাংলা প্রমিত বানানরীতি দুই দশক আগে প্রকাশ করা হয়েছে। যারা মানবে, তাদের দ্বারা ভাষা বিকৃতি হবে না। এখন কেউ মানছে কিনা, সেটা দেখার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। 

পরে বিষয়টি সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদের নজরে নেওয়া হলে তিনি সমকালকে বলেন, ভাষানীতি প্রণয়নের বিষয়টি সরকারের কর্মপরিকল্পনায় আছে কিনা, জানা নেই। তবে আমরা চাই, সাহিত্য-সংস্কৃতির সর্বস্তরে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমিও কাজ করছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d