১০ গডফাদারের ছায়ায় ৬৩ মাদক কারবারি
শীর্ষ পর্যায়ের ১০ গডফাদারের নিয়ন্ত্রণে থেকে ৬৩ জন মাদক কারবারি দেশে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন বলে তথ্য পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত ১০টি মামলা করা হয়েছে। তাঁরা মাদকের কারবার করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। পর্যায়ক্রমে তাঁদের এসব সম্পত্তি জব্দের (ক্রোক) বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিআইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিআইডির তালিকাভুক্ত ৬৩ জন মাদক কারবারি সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন। ১০ জন গডফাদার তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে এরই মধ্যে অভিযান চলছে।
তাঁদের নামে টেকনাফ, ঢাকার আদাবর, টঙ্গী, খুলনা, পাবনা ও চট্টগ্রামে মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে পলাতক থেকে একই কাজ করছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি এলাকায় তাঁদের প্রতিনিধি রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার লোকজনের কাছে মাদক বিক্রি করছেন।
মাদকের প্রভাবে সমাজে হত্যাকাণ্ডসহ মারামারি ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় বিহারি ক্যাম্পে গত কয়েক দিনে মাদক নিয়ে বিরোধের জেরে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল থেকে কয়েক গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই ক্যাম্পে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
মাদক কারবারিদের কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। মামলায় অনেক নিরপরাধ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। তবে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘ক্যাম্পে হট্টগোল চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা চেষ্টা করছি।’
১০ গডফাদার বেপরোয়া
সিআইডির তালিকাভুক্ত ৭৩ জনের মধ্যে ১০ জন গডফাদার। তাঁরা হলেন কক্সবাজারের টেকনাফের নুরুল হক ভুট্টো, সিদ্দিক আহমেদ, শফিক আলম ওরফে শফিক, ফজর আলী, নুরুল কবির, চট্টগ্রামের শফি, ঢাকার আদাবরের নুরুল ইসলাম, টঙ্গীর পূর্ব থানার পারুল, খুলনার শাহজাহান হাওলাদার এবং পাবনার শাহীন আলম। এঁদের মধ্যে দুজন গ্রেপ্তারের পর জামিনে রয়েছেন, অন্যরা পলাতক।
সিআইডির তালিকাভুক্ত ১০ গডফাদার দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁরা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেননি। তাঁদের বেশির ভাগ টেকনাফ ও কক্সবাজারের বাসিন্দা।
সিআইডি সূত্র বলছে, মাদক কারবারে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তিন গডফাদারের প্রায় আট কোটি ১১ লাখ টাকা মূল্যের জমি ও বাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁদের গচ্ছিত এক কোটি এক লাখ ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা জব্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯.১১ একর জমি ও দুটি বাড়ি জব্দ তালিকায় রয়েছে, যার মূল্য ৮.১১ কোটি টাকা। অন্যদের সম্পত্তি ক্রোক করার বিষয় প্রক্রিয়াধীন। এই সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ১৯.৫৩৬ একর জমি, ১১টি বাড়ি এবং একটি গাড়ি, যার মূল্য ২৭.৪৬ কোটি টাকা।
সিআইডিপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, তালিকাভুক্তরা মিয়ানমার ও টেকনাফ থেকে মাদক এনে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। মাদকের প্রভাবে যুবসমাজ আজ ধ্বংসের পথে। তারা কোনো পেশায় না থাকলেও তাদের ব্যাংক লেনদেন অস্বাভাবিক পাওয়া গেছে। বিশেষ করে মাদকের গডফাদাররা মাদকের অবৈধ টাকায় বিপুল সম্পদ গড়েছেন।
মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে সিআইডি ৩৫টি মামলা তদন্ত করে মাদক মামলার হোতা তথা গডফাদারদের মাদক কারবার থেকে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ (ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা), ক্রয়কৃত জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে। এসব মামলায় অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদক বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে গডফাদাররাই প্রধান। মাদক উৎপাদন থেকে শুরু করে মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে গডফাদারদের প্রধান ভূমিকা থাকে। এই গডফাদাররা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও বিত্ত-বৈভবের জায়গা থেকে অনেক প্রভাবশালী। এর ফলে তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় ক্রেতা-বিক্রেতা ও মাদকসেবীরা থাকে। মূলত তাঁদের (গডফাদার) আইনের আওতায় আনা গেলেই মাদক নির্মূল করে যুবসমাজকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব।