রামমন্দির উন্মোচনের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের রক্ত পিপাসা মেটাতে ব্যর্থ হবে মোদির মন্দির
২৬ জানুয়ারি ভারত তার প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে সোমবার দেশটির হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাম মন্দির উদ্বোধন করেন। রাম মন্দিরের প্রান প্রতিষ্ঠার জাঁকালো উৎসবে সরকারের ভূমিকা এবং তারপর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে সহিংসতা ও নিপিড়নের মুখোমুখি হয়েছে, তা অনেকের কাছে এমন একটি দেশকে চিহ্নিত করেছে, যা তার সংবিধান থেকে দূরে সরে গেছে।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারিতে ভারতের জন্য একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। দেশটির স্বাধীনতা-পরবর্তী নেতারা যারা দেশটিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বহুসংস্কৃতির গণতন্ত্র হিসাবে দেখেছিলেন, তাদের বিপরীতে মোদির দল ভারতের পরিচিতিতে আরও স্পষ্টভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ লেপে দিয়েছে।
অযোধ্যার রাম মন্দির থেকে জাতির উদ্দেশ্যে মোদি বলেছেন যে ‘সময়ের চাকা’ ঘুরে গেছে। তিনি বলেন, ‘রাম একটি সমস্যা নয় বরং একটি সমস্যা সমাধান আমরা আগামী এক হাজার বছরের জন্য ভারতের ভিত্তি স্থাপন করছি। আমরা এই মুহূর্ত থেকে একটি সক্ষম, মহান, ঐশ্বরিক ভারত গড়ার শপথ নিচ্ছি।’
মোদির ভাষণের পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর উত্তর প্রদেশ থেকে দক্ষিণ তেলেঙ্গানা পর্যন্ত অন্তত ছয়টি ভারতীয় রাজ্যে প্রতিটি হামলার সহিংসতা হয় ঘটেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উত্তর ভারতের একটি মসজিদে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি জাফরান পতাকা উত্তোলন করে এবং বিহারে একটি মুসলিম কবরস্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়।
দক্ষিণ ভারতে একজন মুসলিম ব্যক্তিকে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো হয় এবং মুসলমান ফল বিক্রেতাদের দোকান পুড়িয়ে দেয়, মধ্য ভারতের একটি গির্জার মাধায় একই হিন্দু জাফরান পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুম্বাইয়ের বাইরে তারা স্থানীয় পুলিশকে মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলি বুল ডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে চাপ দেয়।
মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে মুম্বাইয়ের উপকন্ঠে মুসলিম ছাত্র তারিক চৌধুরী ও তার সহকর্মী তার বাবার ট্রাক চালিয়ে যাওয়ার সময় ২শ’রও বেশি সহিংস হিন্দুবাদী লোহার রড এবং লাঠি নিয়ে তাকে প্রচন্ড মারধোর বরে এবং ‹জয়, ভগবান রাম› বলে চিৎকার করে।
তারিক বলেন, ‹অযোধ্যায় তারা বলেছিল ভগবান রাম আমাদের সকলের। ভগবান রাম কি তাদের শিখিয়েছেন মুসলমানদের টেনে বের করে দিতে, লাঠি দিয়ে পিটাতে এবং বলতে বাধ্য করতে, ‘জয়, ভগবান রাম’?
সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বারা উত্তর ভারতের প্রাচীন শহর অযোধ্যায় ৭১ একরের রাম মন্দিরটি সেই জায়গার ওপর তৈরি করা হয়েছে যেখানে ১৬ শতকের তৈরি বাবরি মসজিদ দাড়িয়ে ছিল, ১৯৯২ সালে হিন্দু উগ্র হিন্দুবাদীরা মসজিদটি ভেলে ফেলে, যার ফলে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান ছিল।
রাম মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয় এবং মঙ্গলবার দুটি শহরে সহিংস হিন্দুবাদীদের ২০ জনেরও বেশি একটি দল ছাত্রদের মারধর বা হয়রানি করে এবং বাবরি মসজিদের ছবি সম্বলিত তাদের পোস্টারে আগুন ধরিয়ে দেয় যখন তারা ‹রাম কে নাম› বা ‹ইন দ্য নেম অফ গড› শিরোনামের ১৯৯২ সালের একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনের চেষ্টা করে, যা অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণার অন্তুরালের বিতর্কিত ইতিহাস নিয়ে তৈরি। বুধবার তারা তথ্যচিত্রটির আয়োজকদের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা এবং জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে কাজ করার মামলা দায়ের করেছে।
রাম মন্দিরের উন্মেচনী পূজার ভার নেয়ার মোদির জীবনীকার যদিও মোদিকে হিন্দুত্ববাদের ‘মহাগুরু’ আখ্যা দিয়েছেন, তবে, সমালোচকরা বলছেন যে, অনুষ্ঠানটি ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক ছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলেছেন, ‘এটি রামের চেয়ে মোদির সম্পর্কেই বেশি ছিল, একজন নির্বাচিত একনায়কের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই রামের গল্পকে সম্পূর্ণভাবে হাতিয়ার বানানো হয়েছে। অযোধ্যায় উৎসব ভারতীয় রাষ্ট্রের দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই মন্দিরটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিজয়ের উদযাপন এবং এটিকে বৈধ করা হয়েছে।’
মোদি জাতিসত্তার উৎসকে দেবত্বের (রামের) সঙ্গে যুক্ত করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সমস্ত মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের সূচকে দেশটি ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে এবং মার্কিন সরকারের অর্থায়িত অলাভজনক ‘ফ্রিডম হাউস’ দ্বারা টানা তৃতীয় বছরের জন্য ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ অভিহিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত বছর বিজেপির পদ্ধতিগত বৈষম্য এবং ধর্মীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি কলঙ্কিত করার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
অপূর্বানন্দ বলেছেন যে, মন্দির নির্মাণ হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রক্ত পিপাসা মেটাতে ব্যর্থ হবে, যা ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় মসজিদ ধ্বংসের সাথে মূলধারায় চলে গিয়েছে। মন্দির খোলার ফলে কেবল আরো সহিংসতা ঘটবে এবং সেই হিংস্র শক্তিগুলি সাহসী হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, ‘এসব কিছুর কোনো সমাপ্তি নেই।’