চিকিৎসক ধর্মঘট: চেম্বার-হাসপাতাল থেকে রোগীরা ফিরছেন, ভোগান্তি
সিলেট, জামালপুরের মতো দূর থেকে আসা রোগীরা পড়েছেন বেশি বেকায়দায়; নারায়ণগঞ্জের রোগীদের অপেক্ষা অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
দুই সহকর্মীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ডাকা গাইনি চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে সমর্থন জানিয়ে অন্য চিকিৎসকরাও সেবা দেওয়া বন্ধ রাখলে রোগীরা ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন; চিকিৎসা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ফিরে গেছেন রোগীরা।
সোমবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দিনভর রোগীরা ভুগেছেন, উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিয়ে। দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি ছিল বেশি।
ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা ও অস্ত্রোপচার বন্ধ রেখে চিকিৎসকরা দুই দিনের কর্মবিরতি পালন করছেন, যা আগের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী চলবে মঙ্গলবারও। ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগে সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করছেন চিকিৎসকরা।
গাইনি চিকিৎসকদের ডাকা এ কর্মবিরতিতে অন্য চিকিৎসকরাও যোগ দিলে সোমবার সকাল থেকে বেসরকারি চেম্বার ও হাসপাতালে জরুরি ছাড়া সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
এদিন ঢাকার হাসপাতালগুলো ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নামিদামিসহ সব ধরনের হাসপাতালে চিকিৎসকদের চেম্বার ছিল বন্ধ। রোগীদের ফিরে যেতে দেখা যাচ্ছে।
পপুলার হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞ মেডিসিন চিকিৎসককে দেখাতে জামালপুর থেকে এসেছিলেন সস্ত্রীক খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, হাসপাতালে কল করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলেন। খুব ভোরে জামালপুর থেকে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ ঢাকায় আসেন। দুই সন্তানকে এক বন্ধুর বাসায় রেখে স্বামী-স্ত্রী পপুলার হাসপাতালে এসে দেখেন চিকিৎসক নেই।
“আমরা টিটু মিঞা স্যারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। হাসপাতাল থেকে গভীর রাতে আমাকে একটা এসএমএস পাঠিয়েছিল। কিন্তু রাতে বলে খেয়াল করি নাই। এখন এসে তো বিপদে পড়েছি। ফিরে যেতে হবে।”
সিলেট থেকে আসা নিয়ামত উল্লাহ নামে আরেক রোগী বললেন, গ্যাস্ট্রোলজির একজন চিকিৎসককে দেখানোর জন্য এসেছেন। কিন্তু চিকিৎসক নেই।
তিনি বলেন, “আমি কাল দেখিয়েছিলাম। একটা পরীক্ষা দিয়ে আজ আবার দেখাতে বলেছিলেন চিকিৎসক। রিপোর্ট নিয়ে এসে বসে আছি। শুনেছি চিকিৎসক আসবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো খবর নেই।”
সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গাইনি ও প্রসূতিবিদ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিল গত শনিবার।
স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান জন্ম দিতে গত ৯ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কুমিল্লার প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখি। সেখানে পরদিন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার সন্তানের জন্ম হয়। ওই নবজাতক সেদিনই মারা যায়।
এরপর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আঁখিকে পাশের ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়; যেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ জুন মারা যান তিনি। এ দুই জনের মৃত্যুতে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী মামলা করলে ওই দুই চিকিৎসককে ১৫ জুন গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এখনও তারা কারাগারে আটক আছেন। জামিন চেয়ে করা তাদের একাধিক আবেদন নাকচ করে দিয়েছে আদালত।
সোমবার ঢাকার গ্রিনরোডের গ্রিনলাইফ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞ সব চিকিৎসকদের চেম্বার বন্ধ। রোগী আসলে তাদের বিষয়টি বলে দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে আড়াই বছরের শিশু কন্যা উনাইজা কায়নাতকে নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসেছেন তার পিতামাতা। সপ্তাহখানেক আগে এই শিশুর হাত ভেঙে যাওয়ায় গ্রিন লাইন হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী সোমবার বিকালে শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখেন কোনো চিকিৎসক নাই।
এ শিশুর বাবা বেলায়েত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আজ চিকিৎসকরা চেম্বারে বসবেন না এটি তাদের জানানো হয়নি।
“ফলোআপের ডেট দেওয়া ছিল আজ। কিন্তু এসে দেখি চিকিৎসকরা কেউ নেই। এমনকি তাদের স্টাফরাও কেউ নেই। আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ৪টায়। তারা চেম্বার না করলে আমাদের জানিয়ে দিলেই হত। ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।”
এ হাসপাতালে নাক, কান, গলার ফলোআপ চিকিৎসা নিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে আসা স্বপন দাস নামের একজনকেও ফিরে যেতে দেখা গেল।
গ্রিনলাইফ হাসপাতালের একজন কর্মী জানান, ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে কাউকে নেওয়া হচ্ছে না।
“শুধু হাসপাতালে যারা ভর্তি ছিল তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর জরুরি বিভাগে কেউ আসলে তাকে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। আগে ডেট ঠিক করা ছিল এমন অনেক সার্জারির ডেট পিছানো হয়েছে। স্যারেরা বলার পর আমরা রোগীদের জানিয়ে দিচ্ছি। যোগাযোগ না করে যারা আসছেন তারা ঝামেলায় পড়ছেন।”
যে হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এ কর্মবিরতি সেই সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়েও দেখা গেছে, চিকিৎসকদের বন্ধ চেম্বারের সামনে কর্মীরা বসে আছেন।
তারা বলেন, প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখি মৃত্যুর পর থেকে এ হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ আছে। দুই দিনের কর্মবিরতির কারণে চেম্বারও বন্ধ। হাসপাতালে রোগী খুব কম। যাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল তাদের ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী ইউসুফ সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কর্মসূচির কারণে ওই হাসপাতালের অন্তত ৯০ শতাংশ চিকিৎসক কাজ করেননি। তবে জরুরি বিভাগে কাজ হয়েছে, রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে চিকিৎসকরা না আসায় পূর্বনির্ধারিত অস্ত্রোপচার হয়নি। সেগুলোর তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার পাশের আরেক নগরী নারায়ণগঞ্জে চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধের পাশাপাশি নতুন রোগী ভর্তিও বন্ধ রাখা হয় হয় অনেক বেসরকারি ক্লিনিকে; পুরোনোদের দু’দিন পর যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা চান চিকিৎসকরা
পাশাপাশি গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরমর্শ দিচ্ছে নগরীর ক্লিনিকগুলো।
চিকিৎসকরা দুই দিন চেম্বার বন্ধ রাখায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও জানায় ক্লিনিকগুলোর কর্তৃপক্ষ।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০০ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
নগরীর শিবুমার্কেট এলাকা থেকে ৭২ বছর বয়সী শাশুড়ি বাছিরুন বেগমকে নিয়ে চিকিৎসক দেখাতে এসেছিলেন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। কিন্তু আসার পর জানতে পারলেন কোনো চিকিৎসকই নেই। আগে জানলে বয়স্ক মানুষ নিয়ে হয়রানিতে পড়ত হত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা সীমিত থাকায় তুলনামূলক চাপ বেড়েছে নারায়ণগঞ্জের সরকারি দুটি হাসপাতালে।
নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল বাশার জানান, রোগীর চাপ সামাল দিতে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল তাদের। বিকেলের পর থেকে সব বিভাগে একজনের বদলে দুজন করে চিকিৎসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জরুরি বিভাগেও দুজন চিকিৎসক রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টাই হাসপাতাল খোলা থাকবে। রোগীরা যেন কাঙ্ক্ষিত সেবা বঞ্চিত না হন সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
একই ধরনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ ফরহাদও।