বছরে কৃষক কমেছে ১৬ লাখ
শিল্প ও সেবা খাত এগিয়ে গেলেও এখনো কৃষি খাতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের কল্যাণে প্রতিবছর বাড়ছে উৎপাদন, যা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু স্বল্প আয়তনের এবং বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে উৎপাদন বাড়লেও আমদানিনির্ভরতা কমেনি।
কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও কৃষকদের জন্য এখনো সৃজনশীল কর্মসংস্থানের খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কৃষি খাত। ফলে নিজস্ব এবং পৈতৃক পেশা ছাড়ছেন অনেক কৃষক। গত এক বছরে প্রায় ১৬ লাখ কৃষক তাদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ তথ্য জানিয়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যান্ত্রিকীকরণ এবং কাজের অনিশ্চয়তা কৃষিপেশাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ৫০ জনের কাজ একজনে করতে পারেন। অন্য পেশায় সারা বছর কাজের নিশ্চয়তা থাকলেও কৃষিতে এ সুযোগ সীমিত। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষি ছেড়ে শিল্প ও সেবা খাতে ঝুঁকছেন তারা।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কৃষি খাতে শ্রমশক্তি ছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কৃষকের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার। বছরের ব্যবধানে কৃষকের সংখ্যা কমেছে ১৫ লাখ ৮০ হাজার। তবে এক বছরে কৃষকের পেশা ছেড়ে যাওয়ার এ তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি (কৃষিতত্ত্ব) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘এক বছরে কৃষকের সংখ্যা এত কমার কথা নয়। সম্ভবত তারা প্রান্তিক চাষি যারা লাভবান হচ্ছে না বা তাদের পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না; অথবা যারা ঋণ নিয়ে ঋণ দিতে পারছে না। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে কিংবা কাজের খোঁজে শহরমুখী হয়েছে।’
কৃষিতে শ্রমিক কমার ব্যাখ্যায় রমিজ উদ্দিন বলেন, দেশের কৃষকদের সব দিক দিয়েই খরচ বাড়ছে। বিশেষ করে শ্রমিকের খরচ বাড়ছে। ধান কাটতে গেলে দৈনিক জনপ্রতি ১ হাজার টাকা লাগে কিন্তু তারা তাদের পণ্যেও ন্যায্য দাম পান না। বিশেষ করে মৌসুমে তারা ভালো দাম পান না।
কৃষকদের মধ্যে এর প্রভাব কী? এমন প্রশ্নের জবাবে এ কৃষিবিদ বলেন, আগে কৃষকদের হেয় করা হতো, কৃষকের ছেলেদের তাচ্ছিল্য করা হতো। এখন কৃষি ওই পর্যায়ে নেই। কৃষি খাতে কৃষক কমার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর যান্ত্রিকীকরণ। এখন কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারে ৫০ জনের কাজ একজন করে ফেলছে। যান্ত্রিকীকরণের কারণে তারা ১০ দিনের জায়গায় ৩ দিন কাজ পাচ্ছে বাকি ৭ দিন বসে থাকছে।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, খাতভেদে দেশে এখন মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার। কৃষি খাতে শ্রমশক্তি কমলেও শিল্প ও সেবা খাতে শ্রমশক্তি বেড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে শিল্প খাতে শ্রমশক্তি দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজারে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার। বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে শ্রমিক বেড়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার।
দেশের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান রাখছে সেবা খাত। এ খাতের শ্রমশক্তিও বাড়ছে। আলোচ্য সময়ে সেবা খাতে শ্রমশক্তি ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা ছিল ২ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ ১১ লাখ ৯০ হাজার শ্রমশক্তি বেড়েছে।
কৃষকের সংখ্যা এমন একসময়ে কমল যখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিকস প্রসপেক্টস ২০২৪ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী চালের সরবরাহ কমেছে ২৭ শতাংশ। ২০২৪ ও ’২৫ সালে জ্বালানির দামবৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়া, বাণিজ্য বিধিনিষেধ ও ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা খাদ্যের দামে প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, লোহিত সাগরে জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের সাম্প্রতিক আক্রমণে সুয়েজ খালে বাণিজ্যের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমেছে। এর জেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
কৃষকরা পেশা ছেড়ে দেওয়ায় দেশের কৃষি উৎপাদন কমবে কি না, কিংবা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কৃষকের পেশা ছেড়ে যাওয়ার সংখ্যাটা বড় হলেও এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় অত বড় প্রভাব এখনই পড়বে না। কারণ কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষিতে সবসময় কিছু ভাসমান শ্রমিক থাকে। তারা এ কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় গিয়ে থাকতে পারে। তবে কৃষির আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন বাড়ছে। বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কাটা পর্যন্ত সবখানে যান্ত্রিকীকরণ বেড়েছে।’
মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষক কমার প্রভাব : গণহারে পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে। বিবিএসের হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম, মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। অথচ অন্য খাতগুলোতে প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। শিল্প খাতে এ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সেবা খাতে ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
এমন সময় দেশের কৃষকের সংখ্যা কমছে, যখন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬৫ শতাংশের ওপর। খাদ্যের জোগানের ক্ষেত্রে যখন আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে ঠিক তখনই কৃষিবিমুখ হচ্ছেন তারা। শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে ৭ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার শ্রমশক্তির মধ্যে যুব শ্রমশক্তি ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ১০ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকদের ৩৭ দশমিক ৯১ শতাংশ কৃষিশ্রমিক, অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এ হার ছিল ৪৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ১১ বছরে কৃষক কমেছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। শুধু কৃষিতেই শ্রমিক কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে কৃষিশ্রমিক কমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কৃষিবিদরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ প্রভৃতি কারণে কৃষিতে আগ্রহ কমছে চাষিদের। একটি প্রথাকেও বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। সেটি হলো, বাবা কৃষিকাজ করলেও সন্তানরা শিক্ষিত হয়ে আর কৃষিতে ফিরতে চান না। তবে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু শিক্ষিত তরুণ বাণিজ্যিক কৃষিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।
ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘একসময় কৃষি সম্ভাবনাময় পেশা ছিল। বর্তমান সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ কৃষিতে কৃষকদের সংশ্লিষ্টতা কমিয়েছে। তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন বা যাচ্ছেন।’
কৃষিজমিতে সরকারি প্রকল্প বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কৃষিজমিতে সরকারি প্রকল্পের হার দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে। ফলে কৃষকরা জমি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকছেন।
কৃষিতে কৃষকের আগ্রহ কমলেও উৎপাদন বাড়ছে। বিবিএসের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটের মোট উৎপাদন হয়েছে ৮৪ লাখ ৫৭ হাজার ৬৭৪ বেল, যা ২০২১-২২-এর চেয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমনের ফলন আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১২৯ শতাংশ বেশি। গমের উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৬৯ শতাংশ বেশি। আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বোরোর উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।