Hot

‘একাই একশ’ নীতিতে আ.লীগ

বিগত সরকারে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ভাগ দেয়নি আওয়ামী লীগ। এবার সংসদেও ভাগ দেওয়া হয়নি তাদের। এবার সরকারে ও সংসদে দলকেই গুরুত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে দলের নারী নেতৃত্ব মনোনয়ন দিয়ে প্রমাণ করেছেন দলনির্ভর চলা শুরু করেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচটি সরকার পর্যালোচনা করলেও দাঁড়ায় দলটি জোট-মহাজোট সঙ্গীদের বাদ দিয়ে নিজেদের শক্তিনির্ভর সরকার গঠন করেছে এবার। একইভাবে সংসদেও নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

কেন জোটসঙ্গীদের সরকারে এবারও রাখা হয়নি, সংসদেও কেন পুরস্কৃত করা হয়নি, সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও রাজনৈতিক বিশ্লেকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেছেন আওয়ামী লীগ দলনির্ভর হয়ে ওঠার মোক্ষম সময় এখনই। গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ জোট নেতাদের ক্ষমতার চেয়ার দিয়েছে। সংসদেও পুরস্কৃত করেছে কিন্তু জোটের একটি দলও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তারা বলেন, ‘খামাখা টানতে যাব কেন’ এ নীতি অনুসরণ করেছেন টানা চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৪ আসন পেয়েছে। দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ৫৯ আসন। অন্য তিন স্বতন্ত্র সদস্যের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। মাত্র ১১টি আসন পেয়ে আবার বিরোধী দল হয়েছে জাতীয় পার্টি। অর্থাৎ এবারের সংসদ প্রায় শতভাগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের। পাঁচবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। কোনোবারই এতটা আওয়ামী লীগনির্ভর হতে দেখা যায়নি সরকার ও সংসদকে।

প্রায় ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেবার জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন পায়। দলটির সমর্থনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই সরকারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আ স ম আবদুর রব ও জাতীয় পার্টির (বর্তমানে জাতীয় পার্টি-জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী ছিলেন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল ও এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি আসন পায়। তখন আসন ভাগাভাগি করা হয়েছিল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে। ওই সরকারেও ১৪ দলের শরিক সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) জিএম কাদের মন্ত্রী ছিলেন। ওই সরকারের শেষদিকে জাসদের হাসানুল হক ইনুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২০১৪ সালেও ১৪-দলীয় জোটের ইনু ও রাশেদ খান মেননকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়। বিরোধী দলে বসলেও জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপি ও তার মিত্ররা ভোট বর্জন করে। ওই নির্বাচনেও আসন ভাগাভাগি হয়। জাতীয় পার্টি ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাসদ ৫, তরিকত ফেডারেশন ২, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি ২টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি আসন পায়। তার মিত্রদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ২২ ও অন্যরা ৮ আসন পায়। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল। সংসদ মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে নিজেরা। তবে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা না এলেও আওয়ামী লীগ জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে যায়নি। মাত্র কয়েকটি আসনে ছাড় দিয়ে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে থাকায় মিত্রদের ভরাডুবিই হয়েছে। সরকারেও রাখা হয়নি জোটসঙ্গী বা বিরোধী জাতীয় পার্টির কাউকে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগির জন্য জোট ও মিত্ররা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাধিকবার দেনদরবার করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, আর কত তাদের টেনে নেবেন। ফলে আসন ভাগাভাগি হয়নি। কিছু আসন ছাড় দিলেও দলের স্বতন্ত্রদের প্রত্যাহার করতে রাজি হননি তিনি।

এবারের সংরক্ষিত মহিলা আসন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মনোনয়ন পাওয়া ৯৯ ভাগ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা বা নেতার পরিবারের সদস্য। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন এমন নারী নেতাকেও সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনীত করেছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সরকারে যেমন ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ নীতি গ্রহণ করেননি, সংসদেও এ কৌশল অনুসরণ করেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ ২০১৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে মিত্রদের কম ছাড় দিয়ে আসছে। এখন স্থানীয় সরকারও আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে জোটের শরিক দলগুলোর কাঠামোগত শক্তি নেই। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়া এই দলগুলোর জনগণের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা নেই। তাই তাদের ক্ষমতা দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে লাভ নেই ভেবে আওয়ামী লীগ এবার দলের ওপর নির্ভর করেই চলার সাহস পেয়েছে।’

বাম রাজনীতি থেকে যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘জোর করে তো জোটের কাউকে চেয়ার দেওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আনুপাতিক হারে সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রতিনিধি পায় না, তাহলে..? তাছাড়া দীর্ঘদিন অনেক দলকে টেনেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু অবস্থান জোরালো করতে পারেনি কোনো দলই। বরং আগের সংসদে যে আসনগুলো পেয়েছিল, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাও ধরে রাখতে পারেনি তারা।’

সরকার ও সংসদ আওয়ামী লীগ নির্ভর এমন পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এ বিষয়ে বলতে পারব না। এটা সঠিকভাবে বলতে পারবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকৃতপক্ষে মন্তব্য করা মুশকিল। তবে সরকারের মন্ত্রিসভায় জোটের প্রতিনিধিত্ব ঐক্যের রাজনীতির ছাপ প্রতিফলিত হতো।’

ইনু বলেন, ‘জোটের প্রতিনিধিত্ব কমতে থাকার ফলে জোটের রাজনীতির রসায়ন সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।’ তবুও জোট আছে বলে দাবি করেন জাসদ সভাপতি।

গত তিনটি সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে দলের বাইরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম কুড়িয়েছেন সেলিব্রেটি, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন নারী ব্যক্তিত্বকে সংসদে যুক্ত করতে দেখা গেছে। এবারই প্রথম সেখান থেকে বেরিয়ে দলীয় নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সরকারে জোটের কোনো নেতাকে না রাখলেও সেবার জোটের নারী নেতাদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দেন প্রধানমন্ত্রী। এবার চিত্র ভিন্ন। গণতন্ত্রী পার্টির একজনকে রাখা হলেও তিনি শরিক দল হিসেবে আসেননি। তাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে।

আওয়ামী লীগ নেতা লেনিন বলেন, ‘সরকার ক্রাইসিসে পড়লে আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়ানো বা দাঁড়ানোর সক্ষমতাটুকু অর্জন করতে পারেনি জোটের শরিক দলগুলো। কোনো ইস্যুতেই সহায়তা পাওয়া যায় না। ফলে আওয়ামী লীগ নিজের শক্তিতেই পথ চলতে শুরু করেছে।’

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠিত হয়। জোটের শরিক অন্য দলগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, জাসদ (ইনু), তরিকত ফেডারেশন, জেপি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের আদর্শে সরকার পরিচালনায় মনোযোগী হয়েছেন। তাই সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়নেও আওয়ামী লীগের ত্যাগী পরিবারের সদস্য ও ত্যাগী নারী নেতাকে বেছে নিয়েছেন সংসদে।

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন জোটকে নিয়ে চললেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছেন জোটের এই দলগুলো সামনে এগোনোর সম্ভাবনা একেবারেই নেই। ফলে শুধু শুধু টানতে যাব কেন? ক্ষমতা দেব কেন? টেনে নেওয়া ও ক্ষমতায় দিয়েও যেহেতু কোনো সুফল পাওয়া যায় না, তাই সেই কৌশলে আর যেতে চান না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে করে নিজের দলের ভেতরেও এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, সমালোচনা দেখা দেয়। তাই নিষ্ফলা এসব দলকে ক্ষমতা দেওয়া যৌক্তিক মনে করে না আওয়ামী লীগ।’

তিনি মনে করেন, জোট করা দলগুলো যদি শক্তিশালী হতে পারত তাহলে এখনই সরকার-সংসদ আওয়ামী লীগ নির্ভর হয়ে উঠত না। অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘জেনারেশন পরিবর্তন করাও আওয়ামী লীগনির্ভর চলতে সাহস জুগিয়েছে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ১৯৭৫ সালের পর দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে এসে দিশাহারা আওয়ামী লীগকে পথ দেখান। তার ও দলের চলার পথ অমসৃণ থাকায় রাজনৈতিক কৌশলে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। দলকে টিকিয়ে রাখতে রাজনীতি করতে হয়েছে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বা ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ করে, সরকারে এসেও তাই করা হয়েছে। ফলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বানাতে হয়েছে জোট নেতাদের।

তিনি বলেন, এ পর্যায়ে এসে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে সুযোগ বেশি দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে জনকল্যাণ মাথায় রেখে যে আদর্শ আওয়ামী লীগ ধারণ করে, সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আনুপাতিক হারে জোট শরিকরা কোনো আসন পায়নি। তাদের জোর করে কি আসন দেওয়া যাবে? এবার সংরক্ষিত আসনে যাদেরই মনোনীত করা হয়েছে, সবাই দলের পরীক্ষিত, ত্যাগী পরিবারের। দলীয় সভাপতি নিজে মনে করেন, তিনি অনেকের কাছেই ঋণী। অনেকের ঋণ শোধ করা হয়েছে এবার।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button