বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ছে, উপর্যুপরি চাপে পড়বে মানুষ
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ফের বাড়ছে। ডলারের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে দর কিছুটা সমন্বয় করা হবে বলে সরকার বলছে। ফলে আগামী মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। নতুন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নতুন করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কনজ্যুমারস এসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ ব্যাপারে বলেন, নতুন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়লে মানুষ মারাত্মক সমস্যার মধ্যে পড়বে। এমনিতেই বাজারে দ্রব্যের মূল্যে বেশি হওয়ায় নিম্নœআয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। ৮০ শতাংশ মানুষের আয় বাড়েনি। সামনে আসছে রমজান। এতে মানুষের ওপর চরম আঘাত আসবে। এটা ভোক্তাদের সঙ্গে জুলুমের শামিল।
এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তিনি বলেন, অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে বার বার বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই মানুষ নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছে, তার ওপর এসব পণ্যের দাম বাড়ালে মানুষের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে সুবিধা দিতে সরকারি অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তা সত্ত্বেও বেসরকারি কেন্দ্রের বেশি দামের বিদ্যুৎ কিনে সরকার এ খাতে বেশি আর্থিক ঘাটতি সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে লাভবান করা হচ্ছে। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে সেটা অযৌক্তিক। তিনি বলেন, লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বন্ধ করতে হবে।
পুরান ঢাকার বাড্ডানগর এলাকায় থাকেন ইয়ারুল মিয়া। সামান্য কাঁচা পণ্যের ব্যবসা করেন তিনি। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে ঢাকায় কোনো রকম জীবনযাপন করেন। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে কষ্টে চলছে তাদের সংসার। নতুন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়লে এর প্রভাবে নতুন করে চাপ তৈরি করবে বলে তিনি মনে করছেন।
চলমান গ্যাস সংকট কাটাতে বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানোর কথা বলে আবারো গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রমতে, এবার শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম ৪৮ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বলা হচ্ছে, আবাসিক সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়বে না। যদিও বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তাদের আবদার পূরণ হলে একমুখী চুলার ক্ষেত্রে ৯৯০ থেকে বেড়ে ১৩৮০ এবং দ্বিমুখী চুলায় ১০৮০ থেকে বেড়ে ১৫৯২ টাকা হতে পারে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে বিইআরসি। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে সর্বশেষ গত বছর ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয় শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগে। তখন আবাসিকে দাম বাড়ানো হয়নি। যদিও আবাসিকের প্রিপেইড মিটারে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কোনো ঘোষণা ছাড়াই।
মিটারে গ্যাস ব্যবহারকারীদের হঠাৎ জানুয়ারি মাস থেকে অতিরিক্ত মিটার ভাড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকা করায় অসন্তোষ বিরাজ করছে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে। বর্তমানে প্রায় ৪৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২৬০ কোটি।
এদিকে, আগামী মার্চে বিদ্যুতের দাম নতুন করে পাইকারি ও ভোক্তাপর্যায়ে বাড়ানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হতে পারে বলে তার কথায় আভাস পাওয়া গেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেখানে দাম কতোটুকু এবং কীভাবে বাড়ানো হবে সেই প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
এর আগে সবশেষ ২০২৩ সালের মার্চ থেকে খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন সরকার বলেছিল, নিয়মিত মূল্য সমন্বয়ের অংশ হিসেবে দাম বাড়ানো হয়। এবার দাম বাড়ানোর পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, স্বল্প মূল্যের বিদ্যুৎ পেতে আমরা কয়লাভিত্তিক অনেক কেন্দ্র চালু করলেও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সেই সুফল পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। গত এক বছরে কয়লার দাম বেড়ে আবার কমে গেলেও টাকার বিপরীতে ডলার অনেক শক্তিশালী হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এখন দাম কিছুটা বাড়াতেই হচ্ছে। সরকার যখন বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় তখন এক ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মান ছিল ৭৫ টাকা। বর্তমানে তা ১১০ থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। কয়লার দামও ঘন ঘন ওঠানামা করছে। টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি সামনে এনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডলারের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে দর কিছুটা সমন্বয় করা হবে। দাম বাড়লেও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে দাম ৩ থেকে ৪ শতাংশ বাড়তে পারে। তবে এতে লাইফ লাইনের গ্রাহকদের ওপর প্রভাব পড়বে না। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব যেন বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে আমরা সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেবো।
দেশে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ী ও বাঁশখালীতে নতুন তিনটি কয়লাভিত্তিক বা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে, যেখানে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। সরকারি সংস্থা পিজিসিবি’র হিসাবে এখন ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট।
নিয়মিত মূল্য সমন্বয়ের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার, যা মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়। সে সময় খুচরায় ৫ শতাংশ বাড়িয়ে বিদ্যুতের নতুন মূল্য হার নির্ধারণ করা হয়। ওই দর অনুযায়ী খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ভারিত গড় হয় ৮ টাকা ২৪ পয়সা, যা ফেব্রুয়ারিতে ৭ টাকা ৮৫ পয়সা ছিল। আর জানুয়ারিতে ছিল ৭ টাকা ৪৮ পয়সা। গত বছর সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।