Trending

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবী মাত্র এক ধাপ দূরে’

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের মাধ্যমে পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন রাশিয়ার প্রতাপশালী নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই পরমাণু যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের সতর্ক করে হুংকার ছাড়তে দেখা গেছে তাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবী মাত্র এক ধাপ দূরে।’

পুতিনের মুখে পারমাণবিক যুদ্ধের কথা আমরা শুনে আসছি বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। চলমান এই যুদ্ধের বিভিন্ন পটভূমিকায় একাধিক বার পারমাণবিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের হুমকি এসেছে পুতিনের মুখ থেকে। অবশ্য তিনি এ কথাও বলেন, ‘পারমাণবিক যুদ্ধ প্রত্যাশা করে না কেউ-ই।’

মনে থাকার কথা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ গত মাসে ইউক্রেনে ফরাসি পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করার কথা বলেছিলেন। যদিও অধিকাংশ পশ্চিমা মিত্র দ্বিমত পোষণ করেছে ম্যাক্রঁর সঙ্গে। ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইতালি ইতিমধ্যে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে ম্যাক্রঁর আহ্বান। এমনকি কেউ কেউ এমনও বলেছেন, রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট!

রুশ বাহিনী কিয়েভ বা ওডেসার দিকে অগ্র্রসর হলে ফরাসি সেনাবাহিনীকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে—ম্যাক্রঁর এমন মন্তব্যের পরেই পরমাণু যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘রাশিয়াকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা চিন্তা করলে তাতে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অংশ হয়ে যাবে না। বরং এতে করে এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।’

ম্যাক্রঁর আরেক মন্তব্যও উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশ খানিকটা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ভয় পেলে চলবে না। কারণ, আমরা কোনো বড় শক্তির মুখোমুখি নই। কোনো আহামরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছি না আমরা। বরং রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী একটি মধ্যম শক্তির দেশ।’ বাস্তবিক অর্থে, এ ধরনের কথার লড়াই সংঘাত দীর্ঘতর করে তোলে।

পুতিনের হাত ধরে পারমাণবিক সংঘাতের সূত্রপাত হোক বা না হোক, ইউরোপের জন্য অপেক্ষা করছে আরেক বিপদ! ইউরোপীয় নেতাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে ‘ডোনাল্ট ট্রাম্পের ফিরে আসার সংবাদ’। মনে করা হচ্ছে, চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরতে পারেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপীয় নেতাদের ধারণা, সত্যি সত্যিই যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন, তাহলে ইউরোপের কপালে দুঃখই আছে! নেতাদের এ ধরনের চিন্তার পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ন্যাটো নিয়ে অনেক বার বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। এই সংগঠনকে ‘অপ্রচলিত, অকার্যকর’ ইত্যাদি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি ট্রাম্প এখনো চরম ন্যাটো-বিদ্বেষী। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণাতে ন্যাটো সম্পর্কে বিষোদগার করা বন্ধ করেননি। সম্প্রতি ট্রাম্প বলেছেন, ‘ন্যাটো তহবিলে নিয়মিত অর্থ প্রদান না করা সদস্য রাষ্ট্রদের বরং রাশিয়ার আক্রমণ করাই ভালো!’

ফিরে আসা যাক ম্যাক্রঁর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সম্ভবত ইউরোপকে রক্ষায় ফ্রান্সের ভূমিকাকে বড় করে দেখাতে গিয়েই ইউক্রেনে ফরাসি সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এর মধ্য দিয়ে হয়তো-বা মিত্রদের তিনি আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে, ইউক্রেনকে জেতাতে সব ধরনের পশ্চিমা উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে ফ্রান্স। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা এক বারও বলেননি ম্যাক্রঁ। অন্যদিকে পুতিন ঠিকই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলেছেন সরাসরি।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেছেন, রাশিয়া অবশ্যই ইউক্রেন যুদ্ধে পরাজিত হবে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে এ-ও বলেছেন, কোনোভাবে যদি ইউক্রেনের পরাজয় ঘটে, তাহলে ইউরোপের ঐক্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা পড়বে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। তিনি তো ভুল কিছু বলেননি।

চলমান এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত যা লক্ষ করা গেছে তা হলো, উভয় পক্ষই থেমে থেমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া খুব সহজেই জয়লাভ করার আশায় থাকলেও তা যেমন ঘটেনি, তেমনিভাবে পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় ইউক্রেন বিজয়ের দ্বরপ্রান্তে বলে যেসব কথা শোনা যাচ্ছিল, তা-ও বাস্তবতার আলো দেখেনি।

এই যুদ্ধে বিজয়ের পাল্লা এখন রাশিয়ার দিকে ঝুলে আছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর মনে হয়েছিল, মস্কো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তবে এই গণনা যে ভুল ছিল, তা আজ সবাই জানে। বরং রাশিয়ার অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো আছে বলেই শোনা যায়। সব থেকে বড় কথা, ৫ম বারের মতো ক্ষমতায় এসে পুতিনকে বেশ আত্মপ্রত্যয়ী বলেই মনে হচ্ছে।

ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের অর্থ ও সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান সত্ত্বেও রুশ সেনাদের দাপট থামানো যায়নি। রাশিয়াকে ধরাশায়ী করা যায়নি। বরং গুঞ্জন আছে, কোনোভাবে রাশিয়ার কৌশলগত পরাজয় ঘটলে তাতে ইউক্রেনের যতটা লাভ হবে, তার থেকে বেশি সুবিধা হবে পশ্চিমা বিশ্বের! পশ্চিমারা এ কারণেই পুতিনকে পরাজিত করতে মরিয়া ভাব দেখায়।

ঠিক এমন একটি প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে ফরাসি সেনা মোতায়েনের ঘোষণা বিতর্ককে উসকে দিয়েছে। এই অবস্থায় ইউক্রেনীয় বাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে পশ্চিমারা নতুন করে অস্ত্র ও সেনা সরবরাহ করলে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে নিশ্চিতভাবে। আর একেই ‘তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ’ হিসেবে অবিহিত করেছেন পুতিন।

এ কথাও সত্য যে, রুশ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট আশার কথাও শুনিয়েছেন। দুই প্রেসিডেন্টের কথার লড়াইয়ের মধ্যে শান্তির সম্ভাবনাও উঁকি মারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—ম্যাক্রঁ বলেছেন, প্যারিসে আসন্ন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় পুতিনকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাবেন তিনি। রাশিয়াকে সংঘাতের পথ এড়িয়ে চলার অনুরোধ করবেন।

মজার ব্যাপার হলো, পুতিন একটা সময়ে বেশ ঘন ঘনই ‘শান্তির কথা’ বলতেন। তবে বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের পর তিনি বেশি মাত্রায় আগ্রাসি ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। মাঝেমধ্যেই পারমাণবিক যুদ্ধের হুংকার দেন। এই অর্থে, পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা গরম নিঃশ্বাস ফেলছে বিশ্বের ঘাড়ে। তাছাড়া বারংবার ‘পারমাণবিক’ শব্দের উচ্চারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করে তুলছে—সেটাই স্বাভাবিক।

মনে রাখতে হবে, ভেতরে ভেতরে আরেক ঘটনা ঘটে গেছে! আফ্রিকায় রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে এই অঞ্চলে ফ্রান্সের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। মূলত এ কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করে আসছে প্যারিস। এই কাজে ফ্রান্সকে বেশ ঘাম ঝরাতে হচ্ছে বটে, তবে এতে বেশ কাজও হচ্ছে! রাশিয়ার সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষ বাধতে পারে—ইউরোপীয় নেতাদের এমন কথা বোঝাতে পেরেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ইউরোপীয় সরকারগুলো যে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুংকারে ভয় পাচ্ছে না, এ কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে? অবশ্যই না। তবে হুট করেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটবেন না পুতিন, এটা একপ্রকার নিশ্চিত। অন্তত আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত পারমাণবিক রিমোট পকেটেই রাখবেন রুশ স্বৈরশাসক।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button