তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভেনিস
ইটালির স্বপ্নময় শহর ভেনিস গোটা বিশ্বের পর্যটক আকর্ষণ করে আসছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। একাধিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ভেনিসের সুরক্ষার উদ্যোগ চলছে। ১,৬০০ বছর আগে থেকেই ভেনিস গোটা বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ। বন্যা ও কোনো এক সময়ে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ও ততই পুরানো।
পানি থেকে সুরক্ষার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ৭৮টি ইস্পাতের প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রয়োজনে উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে। সেই ব্যবস্থার পোশাকি নাম এমওএসই বা মোজে। ভেনিসের বন্যা সুরক্ষা কমিশনর এলিজাবেতা স্পিৎস বলেন, ‘‘মোজে না থাকলে ২০২২ সালের ২২শে নভেম্বর ভেনিস অপূরণীয় ধ্বংসলীলার শিকার হতো। ইতিহাসে দ্বিতীয় উচ্চতম বন্যার স্তর সত্ত্বেও কিছুই ঘটে নি। আমরা উপহ্রদ ও ভেনিস বাঁচাতে পেরেছিলাম।”
এলিজাবেতা ৫০ বারেরও বেশি ফ্লাড গেট খাড়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। মোজে বার বার কাজে লাগানো হচ্ছে। এবার সেটি পুরোপুরি চালু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন জানি, যে মোজে এমন এক নমনীয় হাতিয়ার, যা সব সময়ে এবং একই সঙ্গে বন্ধ করা হয় না। আজ আমরা বন্যা ও বাতাস সম্পর্কে আরো বেশি জানি। সে কারণে আমরা বন্যার মোকাবিলা করতে পারি। উপহ্রদ ও সমুদ্রের মধ্যে পানির আদানপ্রদান নিশ্চিত করতে মোজে প্রণালী আংশিকভাবেও খাড়া করা যায়।”
ভেনিস কি তাহলে রক্ষা পেয়েছে? বিশ্ব জলবায়ু পরিষদের পূর্বাভাস অনুযায়ী শহরের পানির স্তর চলতি শতাব্দীর শেষে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
গেয়র্গ উমগিসার নামের এক সমুদ্রবিজ্ঞানীর মতে, মোজে প্রণালীর মাধ্যমে ভেনিস শুধু কিছুটা বাড়তি সময় পেয়েছে। তিনি বলেনস ‘‘ভেনিস রক্ষা করতে মোজে কি যথেষ্ট? হ্যাঁ, এই মুহূর্তে বা আগামী দশ, বিশ বা তিরিশ বছর পর্যন্ত অবশ্যই সেটা কাজে লাগবে। পানির স্তর ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে গেলে সেই প্রণালীকে ৩০০ থেকে ৪০০ বার খাড়া করতে হবে। অর্থাৎ দিনে একবার তো বটেই। তখন সেই প্রণালীর সীমা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কারণ মোজে সেটা পারবে না। কাঠামো হিসেবে তো নয়ই, উপহ্রদের পক্ষেও সেটা সম্ভব হবে না। উপহ্রদে পানির আদানপ্রদান জরুরি।”
সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রে মার্কো সিগোভিনিও উপহ্রদের ইকোসিস্টেম নিয়ে গবেষণা করছেন। জীববিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মনে করেন যে মোজে প্রণালী কত ঘনঘন খাড়া করা হচ্ছে, উপহ্রদের উপর সেই সংখ্যা কোনো বড় প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু আগামী দশকগুলিতে উপহ্রদ আরো ঘনঘন এবংআরো বেশি সময়ের জন্য সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলে সেই পরিস্থিতি বদলে যাবে। মার্কো মনে করেন, ‘‘এমনও হতে পারে, যে এই উপহ্রদ লবণাক্ত রাখার অর্থ আছে কি না, কোনো এক সময়ে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখার কারণে সমুদ্র ও উপহ্রদের মধ্যে আদানপ্রদানের ছন্দ ভেঙে যাবে, যে চক্র ভেনিসের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ এভাবে উপহ্রদের তলদেশ সৃষ্টি হয়। কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ সেখানে থাকতে পারে, সেটাও এভাবে স্থির হয়। আমাদের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
তাহলে উপহ্রদ না শহর, কোনটা রক্ষা করা উচিত? বলা বাহুল্য, ভেনিসের মানুষ দুটোই চাইবেন।
সেন্ট মার্ক্স স্কোয়্যার ভেনিসের সর্বনিম্ন অংশ। সেখানেই সবার আগে বন্যার পানি আসে। বর্তমানে সেই অংশটিকে উঁচু করার উদ্যোগ চলছে। গেয়র্গ উমগিসার বলেন, ‘‘ধরা যাক, জায়গাটিকে ১১০ সেন্টিমিটার উঁচু করা হলো। তখন সেন্ট মার্ক্স চত্বর আর পানির নীচে চলে যাবে না। কারণ ১১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বন্যা এড়ানো যাবে। উচ্চতা আরো বাড়লে মোজে তা সামলে নেবে। মোটকথা সেন্ট মার্ক্স চত্বরে আর কখনো বন্যা দেখা যাবে না।”
সেইসঙ্গে সাহসেরও প্রয়োজন। উমগিসার মনে করিয়ে দিলেন, যে গত দেড়শো বছরে ভেনিস ২০ সেন্টিমিটার নেমে গেছে। অতিরিক্ত পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই এমনটা ঘটেছে। তবে সেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তরই ভেনিসকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। গেয়র্গ উমগিসার বলেন, ‘‘যে পানি পাম্প করে বার করা হয়েছে, সেটা আবার পাম্পের মাধ্যমে জমিতে ফিরিয়ে দিলে ভেনিস সত্যি আবার ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ গত দেড়শো বছরে আমরা যে ৩০ সেন্টিমিটার হারিয়েছি, হবহু সেই আগের অবস্থা – মানে শূন্যে পৌঁছানো যাবে।”
তবে এই সমুদ্র গবেষকের মতে, ভেনিস অনন্তকাল টিকে থাকতে পারবে না। কোনো এক সময়ে উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। তখন ভেনিসের মানুষকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে উমগিসার বলেন, ‘‘দুটিই রক্ষা করা সম্ভব নয়। কোনো একটির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। উপহ্রদ নাকি শহর হিসেবে ভেনিস রক্ষা করা উচিত? অবশ্যই ভেনিস। ভেনিস একটাই আছে।” কঠিন সিদ্ধান্ত বটে। ভেনিসের মানুষ যত দেরিতে সম্ভব সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশা করছেন।