Bangladesh

ভয়কে হাতিয়ার করে বাণিজ্য, বাড়ছে সিজারে প্রসব

বৃষ্টি আক্তার, দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠের প্রহর গুনছেন। নিয়মিত চিকিৎসক দেখিয়েছেন। স্বাভাবিক প্রসবের আশায় শেষ সময়ে ভর্তি হলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। দায়িত্বরত চিকিৎসক প্রসূতির কাছে গিয়ে বললেন, আপনার মুখ খুব শুকনো লাগছে। বেশি করে পানি পান করেন। পরক্ষণেই বৃষ্টির স্বজনের কাছে গিয়ে তিনি বললেন, প্রসূতির গর্ভের সন্তানের অবস্থা ভালো না, বাঁচাতে হলে দ্রুত সি-সেকশান লাগবে।

স্বজন অনুমতি দিলেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফুটফুটে সন্তানের মা হলেন বৃষ্টি। প্রথমবারের মতো কেন এবার স্বাভাবিক প্রসব হলো না– এ কষ্টের চেয়ে বৃষ্টির আক্ষেপ, চিকিৎসকরা স্বাভাবিক প্রসবের কোনো চেষ্টা কেন করলেন না? রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা বৃষ্টির মতো বেশির ভাগ প্রসূতি চিকিৎসকের পরামর্শে ছুরির নিচে যাচ্ছেন। তবে স্বাভাবিক প্রসবে যোনি কাটাছেঁড়া, অভ্যন্তরীণ আঘাত ও ঝুঁকি নিতে না চাওয়া ছাড়াও প্রসব বেদনা এড়াতে অনেকেই ঝুঁকছেন সিজারে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর চেয়ে স্বজনের পীড়াপীড়ি থাকে বেশি। চিকিৎসকও বাধ্য হন।

এরই ফলে দেশে অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গড়ে ১০০ জনের মধ্যে ৫১ প্রসূতি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক বছরে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। ২০২২ সালে ৪১ দশমিক ৪ থাকলেও ২০২৩ সালে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে স্বাভাবিক প্রসবের হার ৫৮ দশমিক ৬ থাকলেও, ২০২৩ সালে হয়েছে ৪৯ দশমিক ৩। ২০২৩ সালে শহরে অস্ত্রোপচারে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৫৩। অবশ্য ২০২২ সালে বাড়িতে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ শিশু জন্ম নিলেও, ২০২৩ সালে তা নেমে ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে পদে পদে অবহেলা, অবকাঠামো ও সেবা সংকটের কারণে মানুষ ক্লিনিকে যাচ্ছে। বাণিজ্যের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রসূতির অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করছে। আর এটি করতে গিয়ে তারা ‘ভয়কে হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। অস্ত্রোপচার নিয়ন্ত্রণে অন্তঃসত্ত্বাকে নিয়মিত চেকআপ, সরকারি হাসপাতালে ছুটির দিনসহ ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতিসেবা চালু, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, প্রতি ১০০ গর্ভধারণে ১০ থেকে ১৫ প্রসূতির কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিলে মা ও সন্তানের জীবন রক্ষার স্বার্থে সি-সেকশান করতে হয়। এটি জরুরি জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার হলে তা অপ্রয়োজনীয় ধরা হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দুই দশক ধরে বলে আসছেন, সন্তান জন্মদানে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে। তবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এটি রোধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নৈতিকতার ঘাটতিকেও দায়ী করছেন তারা।

জবাবদিহি এবং তদারকি না থাকায় অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব বাড়ছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রে মানা হয় না প্রসব নীতিমালা। শহরের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে তদারকির ব্যবস্থা না থাকাও দায়ী অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের জন্য। অনেক হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় ও নার্সরা অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব কমে গেলে ঢাকার বাইরের ৫০ শতাংশ ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে ক্লিনিকগুলোর বাড়তি মুনাফার প্রবৃত্তি ছাড়াও চিকিৎসকদের নীতিহীনতা অনেকাংশে দায়ী।

তিনি বলেন, স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রসূতিকে যে কাউন্সেলিং করতে হবে, তা করা হয় না। আবার অন্তঃসত্ত্বার স্বজনের চাপেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিজারে বাধ্য হয়। সরকারি হাসপাতালে অবকাঠামো না থাকায় স্বাভাবিক প্রসবের ঝুঁকি নেন না চিকিৎসকরা। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজন, যা এখনও গড়ে ওঠেনি।

গত বছর এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০২২) দেখা গেছে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশ হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে। শিশু জন্মে যত অস্ত্রোপচার হচ্ছে, তার ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে ১৪ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ হচ্ছে এনজিও পরিচালিত কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, প্রসবের ক্ষেত্রে এমনও অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, যার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। অস্ত্রোপচারের কারণে প্রসব-পরবর্তী নানা শারীরিক জটিলতায় ভোগে মায়েরা। অস্ত্রোপচারের কারণে অনেক সময় সংক্রমণও দেখা দেয়। বাড়তি খরচ তো আছেই।

আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়িতে প্রসবে গড়ে মাত্র ১ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ জন্য গড়ে ৬ হাজার ৬০০ টাকা লাগে। কিন্তু সিজারিয়ানে এ খরচ গড়ে ২১ হাজার টাকা হয়ে যায়।

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. ফেরদৌস বেগম বলেন, বর্তমানে অনেক প্রসূতি স্বাভাবিক প্রসবে ভয় পান। এ জন্য তারাই সি-সেকশানের জন্য চাপ দেন। বড় বিষয়– স্বাভাবিক প্রসবে একজন করে নার্স ও মিডওয়াইফ প্রয়োজন। তারা সার্বক্ষণিক মনিটর করবেন। বাস্তবতা হলো, দেশে ১০০ জনেও একজন নার্স ও মিডওয়াইফ নেই। লেবার রুমের পরিস্থিতি মনিটর করার লোকের অভাবে চিকিৎসকরা স্বাভাবিক প্রসবের ঝুঁকি নিতে চান না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button