Science & Tech

মহাশূন্য, মহাবিশ্ব ও পৃথিবী

ঘরবাড়ি ভালো নয় বলে লোকনিন্দা হয়। কিন্তু শূন্যেরও ভেতর কী ঘর বানাবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল লোকশিল্পী হাসান রাজার। সংশয় ছিল বিজ্ঞানীদেরও। তবে শিল্পীর মতো অজুহাত দিয়ে দায় সারেননি বিজ্ঞানীরা।

তাঁরা শূন্যের ভেতরেই ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন, তৈরি করেছেন ঘরের মানুষ। সন্দেহ ছিল আইনস্টাইনের, তাই ইপিআর প্যারাডক্সের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্যারাডক্স ধোপে টেকেনি। 

জয় হয়েছে কোয়ান্টামের।

জয় হয়েছে শূন্যতার শক্তির। আর শূন্যের ভেতর যে ঘরবাড়ি তৈরি সম্ভব তার প্রমাণ আমাদের মহাবিশ্বই।

একসময় পৃথিবীকে সমতল মনে করত মানুষ। তখন একটা প্রশ্ন দেখা দেয় মানুষের মনে, সমতল পৃথিবী কীভাবে শূন্যে ভেসে আছে?

সব কালেই সৃজনশীল ছিল মানুষ।

কেউ যুক্তি দিয়ে, কেউ স্রেফ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষ ব্যাখ্যা চায়, তা সে ব্যাখ্যার ভিত যত ঠুনকোই হোক সামান্য একটু যুক্তি থাকলেই যথেষ্ট। তাদের ধারণা পৃথিবী সমতল, মহাকর্ষ বলের ধারণাও প্রাচীনকালের মানুষের ছিল না। তাই পৃথিবীকে শূন্যে ভেসে থাকার জন্য অবলম্বন দরকার। সুতরাং মানুষ কল্পনা করল দানবীয় সব জন্তু-জানোয়ারের। সেসব জানোয়ারের পিঠে কিংবা কাঁধে সওয়ার হয়ে বসে আছে পৃথিবী!

কিন্তু সেই জানোয়ার কোথায়, কিসের ওপর ভর দিয়ে আছে?

এ নিয়ে একটা মজার ঘটনার কথা লিখেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ের শুরুতেই। সেই বইয়ে তিনি এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর উদাহরণ টেনেছেন। সম্ভবত বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেল। তিনি একদিন এক সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সেই বক্তৃতায় বিজ্ঞানী মশাই পৃথিবীর আকার, মহাবিশ্বের প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেন। বক্তৃতায় যখন শেষ হলো, তখন এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বলললেন, এতক্ষণ আপনি যা বললেন, সব ভুয়া। বিজ্ঞানী তখন বৃদ্ধার মত কী, সেটা শুনতে চাইলেন। বৃদ্ধা বললেন, পৃথিবী আসলে থালার মতো চ্যাপ্টা। 

তখন বিজ্ঞানী জানতে চাইলেন, তাহলে পৃথিবী শূন্যে ভেসে আছে কীভাবে?

জবাবে বৃদ্ধা বললেন, পৃথিবী শূন্যে ভেসে নেই। সেটা দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট কচ্ছপের পিঠের ওপর। 

তখন বিজ্ঞানী জানতে চাইলেন, সেই কচ্ছপ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধা বললনে, সেটা দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পিঠের ওপর। সেই কচ্ছপটা আরেকটা কচ্ছপের পিঠে। নিচের কচ্ছপটার নিচে আরেকটা, তার নিচে আরেকটা…এভাবে অসংখ্য কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই পৃথিবী।

শুধু ওই বৃদ্ধা নয়, প্রাচীনকালে সব মানুষই বিশ্বাস করত পৃথিবী কিছুর না কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে। যে প্রাণীর ওপর দাঁড়িয়ে, সেটা আবার আরেকটা প্রাণীর ওপর দাঁড়িয়ে। পৃথিবীকে যদি এমন কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাহলে অসীম সংখ্যক প্রাণী লাগে। কিন্তু অসীম আমরা বলি ঠিকই, কিন্তু সে তো বাস্তব নয়। কোনো কিছু যদি হিসাবের গ-িতে বস্তুগত চেহারায় আনতে হয়, তাহলে অসীমের হিসাব সেখানে চলে না।


তাই একটার নিচে আরেকটা কচ্ছপ দাঁড়িয়েও যদি থাকে তাহলে একসময় নিশ্চয়ই কচ্ছপ শেষ হয়ে যাবে। শেষ কচ্ছপটি তাহলে কিসের ওপর দাঁড়িয়ে? এ প্রশ্নের জবাব সেকালের কল্পনাবিলাসী পণ্ডিতদের কাছে ছিল না। কিন্তু বিজ্ঞানী জোহান কেপলার আর আইজ্যাক নিউটনের প্রতিষ্ঠিত করা মহাকর্ষ সূত্র সেই সমস্যার সমাধান করে দেয়। কচ্ছপের পিঠ থেকে তাঁরা পৃথিবীকে নামিয়ে আনেন মহাশূন্যে। অবশ্য প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিলেন পৃথিবী গোলাকার। আর গোলাকার পৃথিবী ভেসে আছে মহাশূন্যে। কিন্তু তিনি একটা বড় ভুলও করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, এর চারপাশে ঘুরছে মহাবিশ্বের সকল বস্তু! 
পরে মধ্যযুগে এসে সে সমস্যার সমাধান হয়। এই আধুনিক যুগে এসেও কিন্তু কচ্ছপের সমস্যায় আবার নিমজ্জিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞান। সেই সমস্যাটা হলো বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণকে ঘিরে। একটা প্রশ্ন প্রায় সব বিজ্ঞানপ্রেমীর মধ্যে, মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই যদি মহাবিশ্বের জন্ম হয় তাহলে তার আগে কী ছিল?

সমস্যার শুরু বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক। আইনস্টাইনের কয়েক বছর আগে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশ করেছেন। সেই তত্ত্বের সমাধান করেই রুশ বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান আর মার্কিন বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখালেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু আইনস্টাইন সেটা মানতে নারাজ। কারণ, নিউটনের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব স্থির এবং সসীম। সে সময় ফ্রিডম্যান মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কীভাবে ঘটছে, তার একটা মডেল বা প্রতিরূপ দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মহাবিশ্ব সব সময় সম্প্রসারিত হচ্ছে, এর ফলে প্রতিটা গ্যালাক্সি আরেকটা গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফ্রিডম্যান আরও বলেছিলেন যেসব গ্যালাক্সি যত দূরে তার দূরে সরে যাওয়ার গতিও তত বেশি। কিন্তু বাদ সাধলেন আইনস্টাইন। তাঁর সমীকরণ থেকেই যেহেতু মহাবিশ্বের প্রসারণের বিষয়টা আসছে তখন তিনিই সেটা থামাতে পারবেন বলে ভাবলেন।

এ জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণে আইনস্টাইন একটা বাড়তি ধ্রুবক যোগ করলেন। সেই ধ্রুবকটা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে মহাজাগতিক ধ্রুবক নামে পরিচিত। কিন্তু ওই দশকের শেষ দিকেই মহাবিশ্বের প্রসারণ সত্যি সত্যি ঘটছে- এই  প্রমাণটা এত অকাট্য যে আইনস্টাইনও সেটা মানতে বাধ্য হলেন। তখন মহাজাগতিক ধ্রুবকের জন্ম দেওয়াটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে স্বীকার করে সেটা সমীকরণ থেকে ছেঁটে ফেললেন। কিন্তু সেই ধ্রুবকই বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আবার ফিরে আসে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র নিয়ে। আইনস্টাইন সেটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ করতে, এখন সেটাই ব্যবহার করা হচ্ছে মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণ ব্যাখ্যা করতে।

হাবল যখন নিশ্চিত হলেন মহাবিশ্ব সত্যি সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে, তখন একটা নতুন ভাবনা কাজ করল বিজ্ঞানীদের মাথায়। সেটা হলো, মহাবিশ্বের সব বস্তুই যদি পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে নিশ্চয়ই একসময় একসঙ্গে ছিল। অনেকটা বোমা ফাটার মতো ব্যাপার। বোমাটার পর এর ভেতরের পদার্থ যেগুলোকে আমরা স্পিøন্টার বলি, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে মহাবিশ্বেও কি এমন কোনো ঘটনা ছিল? মহাবিশ্ব কি আগে একটাই বিন্দু ছিল, সেই বিন্দুতেই ঘটে বিস্ফোরণ আর সেই বিস্ফোরণের পরেই জন্ম হয় বস্তুকণার, সময়ের বিবর্তনে সেসব বস্তু গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদিতে পরিণত হয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button